স্বাধীনদেশ টেলিভিশন

পৃথিবীর গল্প -৫ ‘করোনায় চীন – ভারত টেনশন’

সরোয়ার আমিন বাবু

এই করোনা দূর্যোগ, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা সংকট ও লকডাউনেও ইদানীং চীন – ভারত যুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশে বেশ হৈচৈ লেখালেখি। কারণ দুদেশই এখন আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র ও বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার। তাই এটি নিয়ে আলোচনা  স্বাভাবিক। দেখা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি যারা বুঝে তাদের চেয়ে যারা এ বিষয়ে বুঝে না, তারাই বেশী হৈচৈ করছে। তারাই বেশী জ্ঞান দিচ্ছে সবাইকে। ফেইসবুক, ইউটিউব ফাটিয়ে ফেলছে। আমি কোন জ্ঞান দিব না। সে যোগ্যতা আমার নাই। তবে এ নিয়ে আমার একটি ছোট্ট গল্প বলবো। পৃথিবীর গল্প। করোনা দূর্যোগ শুরু হলে লকডাউনে বসে বসে ইতোমধ্যে চারটি ছোট পৃথিবীর গল্প লিখে শেয়ারও করেছি। কেউ কেউ হয়তো পড়েছেন।

আজকের ৫ম গল্পটি হলো একটু ভিন্ন। এ গল্পের সারমর্ম হলো, চীন- ভারত যুদ্ধ হবে না। কারণ যুদ্ধ হলো একটা কৌশল। সীমান্তে সৈন্য, ট্যাংক, হেলিকপ্টার, মিসাইল সমাবেশ কিন্তু সব নয়। আসল হলো কৌশল। মনে রাখতে হবে যুদ্ধ শুধু সীমান্তে হয় না। যুদ্ধের আরেকটি ফ্রন্ট আছে। সেটি হলো আন্তর্জাতিক কুটনৈতিক ফ্রন্ট ও রাজনৈতিক কৌশল। সেই ফ্রন্ট ও কৌশলে ভারত অনেক এগিয়ে আছে। ভারত জানে চীন একটি পরাশক্তি। সুপার পাওয়ার। চীনের বিশাল সমরশক্তির প্রথম ধাক্কাটাই ভারত সামলাতে পারবে না। কারণ ভারত তার সমরশক্তির প্রায় অর্ধেক রিজার্ভ ও স্ট্যান্ড বাই রাখতে হবে শত্রু রাষ্ট্র পাকিস্তান সীমান্তে। তাই বাকী অর্ধেক সমরশক্তি দিয়ে চীনকে মোকাবেলা করা অসম্ভব। তার উপর আছে মিয়ানমার। চীনের ইশারায় চলে মিয়ানমার। ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা নেপালও এখন ভারতকে শাসায়। শুনলে মোদের হাসি পায়। শ্রীলঙ্কায় চীন বন্দর নির্মাণ করছে। তার মানে সেও ভারতের পাশে নেই। ভুটান ইতোমধ্যেই বলে ফেলেছে, আমি বাপু এসবের মধ্যে নেই। কেমনে থাকবে সে, তার তো কোন সামরিক বাহিনীই নেই। তার মানে ভারতের পাশে তার প্রতিবেশী কেউ নেই। বাংলাদেশ থাকবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। ফলাফল হলো ভারত একা, বড়ই একা। তবে দাবা খেলায় ভারত ওস্তাদ। প্রাচীন ভারতের কৌশলী কুটনীতিক চানৈক্যের উত্তরসূরী সে। আন্তর্জাতিক কুটনীতিতে ভারত বড় খেলোয়াড়। সে অনেক অভিজ্ঞ। ভারত জানে চীনের সীমান্ত শুধু ভারতের সাথে নয়। চীনের সীমান্ত রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের (প্যাসিফিক) বিশাল অংশজুড়ে। যেখানে রয়েছে জাপান। আরো রয়েছে আমেরিকান নৌবহর ও ঘাঁটি। শুধু তাই নয়, সেখানে সব সময় সক্রিয় আমেরিকান মিলিটারির ইন্ডো প্যাসিফিক কমান্ড। জাপান এখানে আঞ্চলিক বড় শক্তি। যেখানে আমেরিকার উপস্থিতি আছে সেখানে জাপান পরাশক্তি থেকেও বেশী। কারণ জাপান ও আমেরিকা এখন বড় মিত্র। জাপান কিন্তু যুদ্ধ করতে চাইবে না। কিন্তু আমেরিকা যখন প্রশান্ত মহাসাগরে যুদ্ধে জড়াবে তখন জাপান চুপ থাকবে না। আমেরিকা চায় এখানে একটা যুদ্ধ হউক। কিন্তু জাপানের পলিসি হলো যুদ্ধে না জড়ানো। কুটনীতিতে জাপান অনেক বুদ্ধিমান ও পরিপক্ব।  চীন তার বৃহৎ প্রতিবেশী। চীনের সাথে রয়েছে  তার বড় ব্যবসা। তাই সব কিছু মিলিয়ে জাপান চাইবে চীনকে যুদ্ধে না জড়াতে। 

তাছাড়া দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের কর্তৃত্ব নিয়ে এ অঞ্চলে আরেকটি উত্তেজনা রয়েছে। আবার  প্রশান্ত মহাসাগরীয় সব দেশের সাথে চীনের বড় বড় ব্যবসা। তাই সেখানে সেও যুদ্ধ করতে চাইবে না।  আবার  এটা স্পষ্ট যে, ভারতের পাশে থাকবে জাপান ও আমেরিকা। ভারত, জাপান ও আমেরিকা যৌথ মহড়াও চালিয়েছে।  আমেরিকা কিন্তু বসে আছে যুদ্ধ করার জন্য। কারণ যুদ্ধ না করলে তার ঘুম হয় না। করোনা ইস্যু নিয়ে চীনকে সাইজ করার জন্য আমেরিকা ছুতো খুজছে। তাহলে বুঝা গেল, যুদ্ধ শুধু চীন – ভারত সীমান্ত নয়। যুদ্ধ হবে প্রশান্ত মহাসাগরেও। আমেরিকা ও চীনের যুদ্ধে জড়ানো ও না জড়ানোর উপর নির্ভর করছে ভারতের যুদ্ধ যাওয়ার সিদ্ধান্ত। জাপানই এখানে বড় ফ্যাক্টর। জাপান না চাইলে আমেরিকা চীনের সাথে লড়তে যাবে না। আবার জাপান ছাড়া চীনের সাথে আমেরিকার যুদ্ধ করাটাই বোকামি। অতএব এখানেও যুদ্ধ হবে না।  চীনের ধাক্কা ভারত সামলাতে পারবে না। অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগরে জাপান ও আমেরিকার ধাক্কা চীন সামলাতে পারবে না।  তাহলে হিসেব নিকেশে কি দাড়াল? ফলাফল শূন্য। তার মানে যুদ্ধ হবে না। চীন ও ভারত এইসব কিছু বুঝেই তারা যুদ্ধে জড়াবে না। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতিতে এটাকে বলা হয় ব্যালেন্স অব  পাওয়ার বা শক্তির ভারসাম্য।

ভারতের সাফল্য হলো এসব বিষয় নিয়ে চর্চা করছে সে অনেক আগে থেকেই। তবে চীন- ভারত উত্তেজনার মধ্যে ভারত একটি বড় শিক্ষা পেল। সেটা হলো, প্রতিবেশী যত ছোট হোক, সবাইকে সম্মান ও মর্যাদা দিলে তার নিজেরই লাভ। আরেকটি বড় শিক্ষা পেল ভারত। তার দুঃসময়ে প্রতিবেশী সবাই তার সাথে দুর্ব্যবহার করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সব সময় ভারতকে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে। ভারত বুঝল, বাংলাদেশ আসলেই একটি মহৎ ও মানবিক রাষ্ট্র। অন্যদিকে এই উত্তেজনায়  বাংলাদেশ নিজেকে আবিষ্কার করল একটি বড় আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে। চীন ও ভারত উভয়ের কাছেই বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ। অতএব জয় বাংলা।

লেখক: কলামিস্ট, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পাদক, চট্টগ্রাম রিপোর্টার্স ফোরাম।

আরো সংবাদ