স্বাধীনদেশ টেলিভিশন

নারী আইনজীবী হয়েও করোনায় ফ্রন্ট ফাইটার হিসেবে লড়েছেন জিনাত সোহানা

অদৃশ্য জীবাণু করোনাভাইরাসে আজ দিশেহারা পুরোবিশ্ব। যে ভাইরোস প্রতিদিন হাজারো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এই করুণ সময়ে একজন নারী আইনজীবী হয়েও ফ্রন্ট ফাইটার হিসেবে লড়েছেন চট্টগ্রামের জিনাত সোহানা চৌধুরী।

করোনা রোগী তো দূরের কথা স্বাভাবিক জ্বর-সর্দির কথা শুনলেই লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছিলো কিছু মানুষ। করোনা সন্দেহের জেরে কোথাও নিষ্ঠুর প্রতিবেশিরা মিলে একঘরে বেঁধে রাখছেন উপসর্গ থাকা রোগীকে। আবার কোথাও এই বিষ বাষ্পের ভয়ে নিজের আপন জনের শেষ বিদায় দিতে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেকের। এসব ঘটনার বাইরে এই শহরে ব্যতিক্রমও কিছু মানুষ রয়েছেন।

চট্টগ্রামে কোথাও ছোট ছোট দলে ভাগ কিছু যুবক-যুবতীরা লড়ছেন করোনার বিরুদ্ধে। গড়ে তুলছেন বিশেষ হাসপাতাল। প্রতিটি সেক্টরের যোদ্ধারা করোনার ঝংকার থামাতে লড়ছেন নিজস্ব কায়দায়। তরুণ ফ্রন্ট ফাইটারদের সাথে হেরে একদিন করোনা বিদায় নেবে। সেই কথা এখনই আঁচ করা যাচ্ছে।

তরুণ-তরুণীরা বলছেন, ফ্রন্ট ফাইটার হওয়ার জন্য বয়সটা মোটেও বিবেচ্য বিষয় নয়। বরঞ্চ প্র‍য়োজন কাঁচা সবুজ মন এবং জোটবদ্ধ প্রচেষ্টা। ফ্রন্ট ফাইটারদের বিশ্বাস জোটবদ্ধ হাতের ইশারায় একদিন থেমে যাবে করোনা। এমন বিশ্বাসীদের একজন এ্যাডভোকেট জিনাত সোহানা চৌধুরী। পেশায় তিনি একজন আইনজীবী।

দেশের দুর্দিনে নিজেকে বার বার প্রমাণ করেছেন একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে। সামাজিক প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে কাজ করছেন দেশের জন্য। যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনদিন বাজেনি জাতীয় সংগীতের সুর, সেখানে তিনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমাবেশ ঘটিয়ে জাতীয় সংগীত গেয়েছেন দৃঢ় কন্ঠে। কওমী মাদ্রাসার কচি কচি প্রাণে সঞ্চার করেছেন সোনার বাংলার গান। অথচ সেই সব মাদ্রাসায় এক সময় নিষিদ্ধ ছিল জাতীয় সংগীত! পরে আলেম-ওলামাদের নিয়ে তিনি সেখানে প্রথম বারের মত চালু করেছেন জাতীয় সংগীত গাওয়ার রীতি। আস্থা আর ভালোবাসা দিয়ে বুঝিয়েছেন জঙ্গিবাদে না জড়ানোর শপথ বাক্য।

তবে এবারের যুদ্ধ আরও কঠিন শত্রুর বিরুদ্ধে। সেই নীরব ঘাতক করোনা। গোপনে ছড়িয়ে পড়ে রোজ গিলছে মানুষ! অতি ছোঁয়াছে এই রোগের নাম শুনলেই যখন মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে। তখন এই নারী নেত্রী নিজের রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে চট্টগ্রামে গড়ে তুলেছেন করোনা আইসোলেশন সেন্টার। আর করোনা সংক্রমণ রোধে শুরু থেকে মানুষকে সচেতন করার প্রচেষ্টা তো আছেই। দায়িত্ব পালন করছেন চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরে অবস্থিত চট্টগ্রাম আইসোলেশন সেন্টারের মুখপাত্র হিসেবে। 

এমন দুর্দিনে মানুষের সেবা দিতে ঘরে-বাইরে ছুটছেন চট্টগ্রামের এই নারী কাণ্ডারী। পশ্চাৎপদ সংস্কৃতি ছুড়ে ফেলে দিয়ে মাথায় পেতে নিয়েছেন ঝুঁকি।করোনা ক্রান্তিকালে যখন করোনা কিংবা উপসর্গের রোগী থেকে দূরে পালিয়ে যাচ্ছে। এমন কি কোথাও কোথাও পরিবারের সদস্যরাও করছেন নিষ্ঠুর আচরণ। ঠিক সেই সময়ে এই নারী কাণ্ডরী করোনা কিংবা উপসর্গের রোগী পেলে স্নেহ মমতা দিয়ে কাছে টেনে নিয়েছেন পরিবারের মত করে। এসব করতে গিয়ে নিজের পরিবারকে সময় দেওয়া হচ্ছে না। এই নিয়ে বেশ আক্ষেপ থাকলেও কিংবা অভিমানও সহ্য করতে হলেও সব সময় সহযোগিতাও পেয়েছেন পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে। সব মিলে এক বুক আশা বুকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সংগ্রামের এই জীবন।

সুচিন্তা বাংলাদেশ চট্টগ্রামের সম্বনয়ক জিনাত সোহানা চৌধুরী বলেন, ‘দুর্দিনে হাত গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। বহু সংকট মোকাবেলা করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শক্তিই জীবনকে স্বার্থক করে তোলে। সরকারের একার পক্ষে এই শত্রু  মোকাবেলা করা অনেক কঠিন। তাই প্র‍য়োজন জোটবদ্ধ প্রচেষ্টা।’ 

পরিবারের ঝুঁকির কথা ভাবতে গেলে মনটা দীর্ঘশ্বাসে ভরে উঠে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন নিজেদের গড়ে তোলা আইসোলেশন সেন্টারে আসতে হয়। রোগীদের সেবা দিচ্ছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংকট মোকাবেলায় সবাইকে কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আমি তাঁর একজন ক্ষুদ্র কর্মী হয়ে সেটা অনুসরণ করছি। সবার ভালো থাকার মধ্যেই নিজেকে খুঁজে নিয়েছি।’

তবে এই পথ চলা সহজ ছিলো না। প্রথম দিকে এই আইসোলেশন সেন্টার খুব উন্নত ছিলো না। পরে সেবার মান বাড়াতে  উদ্যোক্তাদের সকাল-সন্ধ্যা মিটিং। পরিবারের হাসি মাখা মুখগুলোকে বিদায় দিয়ে জিনাত সোহানা প্রতিদিনই ছুটে আসেন সেখানে। প্রতিদিনই নিত্য নতুন সমস্যা সামনে আসে। তবে সব বাধা মোকাবেলা করে ধীরে ধীরে বেড়েছে এই আইসোলেশন সেন্টারের সেবার মান ও সুযোগ সুবিধা। এতেও চট্টগ্রামের বিত্তশালীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন আইসোলেশন সেন্টারের মুখপাত্র সোহানা।

 অসহায় মানুষের জন্য সহ যোদ্ধাদের উজাড় করা ভালোবাসায় এই পথে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জানিয়ে জিনাত সোহানা বলেন, ‘আমরা নিজের জীবন ঝুঁকি সুতায় ঝুলিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। তবে এইটুকু পথ চলা মোটেও সহজ ছিল না। সব ভালো লাগার সাথে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা এই পথের সঙ্গী হয়েছে।’

চট্টগ্রামে জামায়াত অধ্যুষিত অসংখ্য মাদ্রাসায় জঙ্গিবাদ বিরোধী সভা-সমাবেশ করেছেন এই সংগ্রামী নারী। জিনাত সোহানা বলেন, ‘এসব মাদ্রাসায় ভুল পথে পরিচালিত হতো ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা। তাদের মূল ধারায় নিয়ে আসার ভাবনা থেকেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

তাছাড়া এই নারী যোদ্ধা চট্টগ্রাম কারাগারে টানা তিনবার ধরে দায়িত্ব পালন করছেন বেসরকারি কারা পরিদর্শক হিসেবে। আইসোলেশন সেন্টারের এর অন্যতম এই উদ্যোক্তা বর্তমানে নিয়োজিত আছেন সেন্টারের  মুখপাত্র হিসেবে।

পরিবারের বাইরে তারুণ্যর শক্তিতে ভর করে তিনি গড়ে তুলেছেন অন্য একটি পরিবার। এত সব কাজের মধ্য দিয়েই চট্টগ্রামে বিপদগ্রস্থ মানুষের ভরসা হয়ে উঠেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কুড়িয়েছেন বেশ প্রশংসা।

তবে নতুন ভোরের অপেক্ষায় প্রতিটি মুহুূর্ত কাটছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একদিন সব শোক মুছে দিয়ে বিজয়ের কেতন সবাই মিলে উড়াবো। আমরা সুন্দর একটি ভোরের সাক্ষী হবো। সেই অপেক্ষায় আছি। ‘

আরো সংবাদ