স্বাধীনদেশ টেলিভিশন

সৌদি আরবে তুর্কি পণ্য বয়কটের হিড়িক

মুসলিম বিশ্বের দুই প্রধান শক্তির রাজনৈতিক রেষারেষির ধাক্কা এখন তাদের বাণিজ্য সম্পর্কের ওপর আছড়ে পড়তে শুরু করেছে।

গত অক্টোবর মাস থেকে সৌদি এবং তুরস্কের মিডিয়া ছাড়াও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে দিনের পর দিন যেসব খবর বেরুচ্ছে, তাতে স্পষ্ট যে সৌদি আরব তুরস্কের এরদোগান সরকারকে শায়েস্তা করার উপায় হিসাবে বাজার বন্ধের কৌশল নিয়েছে।

নির্ভরযোগ্য ব্রিটিশ দৈনিক ‘ফাইনানসিয়াল টাইমস’ বলছে যে সৌদি আরব তুরস্কের পণ্য আমদানির ওপর ‘অনানুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা’ চাপিয়েছে।

যদিও মিডিয়ার প্রশ্নের মুখে সৌদি সরকার এখনো বলে যাচ্ছে যে তুরস্ক থেকে পণ্য আমদানির ওপর রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক এবং তুরস্কের ব্যবসায়ী মহল অবশ্য নিশ্চিত যে তুর্কি পণ্য বয়কটের যে ক্যাম্পেইন দ্রুত সৌদি আরবে ছড়িয়ে পড়েছে তার পেছনে রয়েছে দেশটির সরকার।

সৌদি সরকারের ইচ্ছাতেই যে এই বয়কট ক্যাম্পেইন চলছে, তার প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায় গত সপ্তাহে, যখন সৌদি খাদ্য এবং ওষুধ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ (এসএফডিএ) তুরস্ক থেকে সব ধরনের মাংস, মাছ, ডিম এবং দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য আমদানি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত জানায়।

তুরস্কের ইংরেজি দৈনিক সাবাহ এবং আরও কিছু মিডিয়া জানিয়েছে যে তুর্কি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সৌদি এই সিদ্ধান্তের কথা নিশ্চিত করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে দেশের রপ্তানি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সৌদি এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

‘না আমদানি, না বিনিয়োগ, না ভ্রমণ’

প্রকাশ্যে এই ‘তুর্কি বয়কট’ ক্যাম্পেইনের নেতৃত্ব দিচ্ছে সৌদি আরবের শীর্ষ এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সমিতি – রিয়াদ চেম্বার অব কমার্স।

সমিতির প্রধান আজলান আল-আজলান অক্টোবরের মাঝামাঝি এক বিবৃতি জারী করে ‘সৌদি নেতৃত্ব, দেশ এবং সৌদি জনগণের বিরুদ্ধে অব্যাহত বৈরি আচরণের’ প্রতিবাদে তুরস্কের তৈরি সব কিছু বর্জনের ডাক দেন।

বিবৃতির মূল বার্তা ছিল- তুরস্কে কোনো বিনিয়োগ নয়, তুরস্ক থেকে কোনো আমদানি নয় এবং তুরস্কে কোনো পর্যটন নয়।

রিয়াদ থেকে রয়টার্স বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, সৌদি চেইন সুপারমার্কেটগুলো একে একে বয়কটের এই ডাকে সাড়া দিচ্ছে।

সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় সুপারমার্কেট আথায়াম ছাড়াও দানিউব, তামিমি এবং পাণ্ডা চেইন শপ বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে যে তাদের বর্তমান মজুদ শেষ হওয়ার পর তারা তুরস্কে তৈরি কোনো পণ্য বিক্রি করবে না।

আথায়াম সুপারশপ কর্তৃপক্ষ টুইটারে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেছে, আমাদের নেতৃত্ব, সরকার এবং নিরাপত্তা আমাদের রেড লাইন। এই তিনটি বিষয়কে খাটো করা হলে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না।

অনেক দোকানের সামনে বড় হোর্ডিং টাঙ্গিয়ে তুর্কি পণ্য না কেনার আহ্বান জানানো হচ্ছে। সেই সাথে গত মাস খানেকের ওপর ধরে চলছে সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘বয়কট-টার্কিশ প্রডাক্টস’ হ্যাশটাগে ব্যাপক প্রচারণা।

ফলে এক দিকে যেমন দোকানের শেলফ থেকে তুরস্কের পণ্য খালি হয়ে যাচ্ছে, সেই সাথে অবশিষ্ট পণ্যগুলোর দিকে বহু ক্রেতা হাত বাড়াতে কুণ্ঠা বোধ করছেন বলে রয়টার্সের এক রিপোর্ট জানাচ্ছে।

তলানিতে রিয়াদ-আঙ্কারা সম্পর্ক

সরকারপন্থি সৌদি বিশ্লেষক, বুদ্ধিজীবীরা গণমাধ্যমে এই বয়কটের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে জনমত তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

সম্প্রতি আরব নিউজ পত্রিকায় সুপরিচিত সৌদি রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক ড. হামদান আল-সেহরি বলেছেন যে ‘মধ্যপ্রাচ্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তুরস্কের মাথা গলানোর কারণেই’ এই জনপ্রিয় বয়কট।

তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট এরদোগান তার অভ্যন্তরীণ সমস্যা এখন দেশের বাইরে চালান করছেন। ইরানের মত তুরস্কও এখন এই অঞ্চলকে হুমকি দিচ্ছে। সন্ত্রাসী মিলিশিয়াদের সমর্থন দিচ্ছে, মুসলিম ব্রাদারহুডকে উস্কানি দিচ্ছে। এতে আরব দেশগুলোর নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ছে।

আরব বিশ্বের নেতৃত্ব, প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে সৌদি আরব এবং তুরস্কের মধ্যে রেষারেষির পারদ ক্রমেই চড়ছে।

২০১১ সালে তথাকথিত আরব বসন্তের প্রতি তুরস্কের অকুণ্ঠ সমর্থনের পর থেকে রিয়াদ-আঙ্কারার সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে।। এরপর ২০১৭ সালে সৌদি আরব এবং তার মিত্ররা যখন কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তখন প্রেসিডেন্ট এরদোগান কাতারের সমর্থনে এগিয়ে আসেন।

এরপর ২০১৮ সালে ইস্তান্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের মধ্যে সাংবাদিক জামাল খাসোগজির হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রেসিডেন্ট এরদোগান যেভাবে সৌদি রাজপরিবারকে দায়ী করেছেন, তাতে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে।

বয়কটের পরিণতি

আমদানির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তুরস্ক সৌদি আরবের ১২তম বাণিজ্য সহযোগী দেশ। ২০১৯ সালে তুরস্ক থেকে সৌদি আরব ৩২০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে।

যদিও সৌদি দৈনিক আল আরাবিয়ায় এই বয়কট নিয়ে এক নিবন্ধে অর্থনৈতিক বিশ্লেষক আমাল আব্দুল-আজিজ আল-হাজানি বলেছেন, রাজনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হওয়ার সাথে সাথে ২০১৭ সাল থেকে সৌদি-তুরস্ক বাণিজ্য সম্পর্ক সঙ্কুচিত হচ্ছে। গত দুই বছরে বাণিজ্য হ্রাস পেয়েছে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ।

তুরস্কের নির্মাণ সামগ্রী প্রস্তুতকারী সমিতির প্রধান ফেরদি এরদোগানকে উদ্ধৃত করে রয়টার্স বলছে, প্রায় বছর খানেক ধরেই সৌদি আরবে তুর্কি পণ্য এবং সেবা আমদানির ওপর বাধা তৈরির ইঙ্গিত তারা পাচ্ছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরেই সৌদি কাস্টমস বন্দরগুলোতে নানা রকম জটিলতা তৈরি করছে।

বিশ্বের বৃহত্তম কনটেইনার শিপিং প্রতিষ্ঠান মায়ের্সক সম্প্রতি তুরস্কের রপ্তানিকারকদের জানিয়েছে যে তুর্কি পণ্য খালাসের সময় সৌদি কাস্টমসের পক্ষ থেকে নানাবিধ জটিলতা তৈরি করা হচ্ছে।

সৌদি আরবে তুরস্কে তৈরি পণ্যের ওপর অনানুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো সঙ্কটে পড়ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

লন্ডনের ফাইনানসিয়াল টাইমস খবর দিয়েছে, স্প্যানিশ ব্রান্ড ম্যাঙ্গো – যাদের পোশাকের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ তৈরি হয় তুরস্কে, তারা সৌদি আরবে বিক্রির জন্য বিভিন্ন দেশে পোশাক তৈরির বিকল্প রাস্তা খুঁজছে। সৌদি আরবে ম্যাঙ্গোর ৫০টির মত দোকান রয়েছে।

ম্যাঙ্গো তুরস্কে তাদের সরবরাহকারীদের জানিয়েছে, সৌদি কাস্টমস মাল খালাসে এত দেরি করছে যে অন্য দেশে পোশাক তৈরি ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই।

ইস্তান্বুলে তৈরি পোশাক সমিতির প্রধান মুস্তাফা গুলতেপ ফাইনানসিয়াল টাইমসের কাছে স্বীকার করেছেন যে তুরস্কে তৈরি পণ্য সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় কিছু দেশে নিতে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর সমস্যা হচ্ছে।

তুরস্কের আটটি প্রধান ব্যবসায়ী সমিতি গত মাসে যৌথ বিবৃতিতে তুরস্কের কোম্পানিগুলোর প্রতি সৌদি আরবের ক্রমবর্ধমান নেতিবাচক আচরণের তীব্র নিন্দা করেছে। এই বিরোধ মিটিয়ে ফেলার আহ্বান জানিয়ে তারা বলেছে যে এটা না হলে দুই দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আত্মঘাতী বয়কট

তুরস্ক সরকারের পক্ষ থেকে সৌদি আরবে এই বয়কটের বিষয়ে এখনো কিছু শোনা যায়নি। তবে সরকারপন্থি তুর্কি সংবাদপত্র ইয়েনি সাফাকে এক উপ-সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে যে এই বয়কট সৌদি আরবের জন্যই আত্মঘাতী হবে।

এক্ষেত্রে এমন যুক্তি দেওয়া হয়েছে – তুরস্কের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের তুলনায় সৌদি আরবে তাদের রপ্তানির পরিমাণ এতই কম যে তাতে তুর্কি অর্থনীতির তেমন কোনো ক্ষতি হবে না, বরং ৮০ শতাংশ আমদানি নির্ভর সৌদি আরব সস্তায় মানসম্পন্ন পণ্য থেকে বঞ্চিত হবে।

ইয়েনি সাফাকের উপসম্পাদকীয় বলছে, সৌদি জানগণ এটা কখনই পছন্দ করবে না। সবাই জানে সৌদি সরকার এই বয়কটে তাদের বাধ্য করছে। তুরস্কের সাথে সাধারণ আরব জনগণের কোনো বিরোধ নেই।

সৌদি অর্থনৈতিক বিশ্লেষক আমাল আব্দুল-আজিজ আল-হাজানি অবশ্য বলছেন যে তুরস্ক থেকে খাদ্য পণ্য আমদানি বন্ধ করলে তুর্কি অর্থনীতি হয়ত তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, কিন্তু অর্থনৈতিক সম্পর্ক এভাবে নষ্ট হতে থাকলে তার নেতিবাচক অনেক প্রভাব তুরস্ক এড়াতে পারবে না।

তার হিসাব এ রকম- সৌদিরা তুরস্কে স্থাবর সম্পত্তির সবচেয়ে বড় ক্রেতা। একশোরও বেশি তুর্কি কোম্পানি সৌদি আরবে ব্যবসা করছে। এক লাখের মত তুর্কি নাগরিক সৌদি আরবে কাজ করে।

তাছাড়া আমাল আব্দুল-আজিজ বলেন, তুরস্ক ২০২৩ সালের মধ্যে ২,৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের সৌদি বিনিয়োগ টার্গেট করেছিল, আর দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২,০০০ কোটি ডলারে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।

রাজনৈতিক সম্পর্ক চটে যাওয়ায় তুরস্কের এসব টার্গেট শুধু কাগজে থেকে যাবে, মনে করছেন সৌদি এই বিশ্লেষক।

আরো সংবাদ