স্বাধীনদেশ টেলিভিশন

তাকদীর: বাংলা ওয়েব সিরিজে নতুন দিগন্তের সূচনা

চলতি মাসের শুরুতে যখন তাকদীরের ট্রেলার মুক্তি পেল, এর সিনেমাটোগ্রাফি এবং নির্মাণশৈলী তখনই দর্শকের কাছ থেকে প্রশংসা কেড়ে নেয়। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের নিয়মিত দর্শকেরা তাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন, যে আলোচনা -উত্তেজনা ‘হইচই’ এর এই সিরিজটি নিয়ে শুরু হয়েছে তা শেষ পর্যন্ত কতখানি পর্দায় ফুটে উঠবে।

অভিনয়শিল্পীরা যার যার চরিত্রে ছিলেন অনবদ্য। সিরিজের মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের সবচাইতে নিখুঁত অভিনয়শিল্পীদের একজন, চঞ্চল চৌধুরী। পার্থ বড়ুয়া, সানজিদা প্রীতি, মনোজ কুমার প্রামাণিকের মত নিপুণ অভিনয়শিল্পীরাও তাদের পুরনো কাজগুলোর মতই নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার রেখে ‘তাকদীরের’ সুনাম বাড়িয়েছেন।

সিরিজটি দেখার একেবারে শুরুতেই যা আপনার মন কেড়ে নিবে তা হলো এর মনোজ্ঞ সূচনা সংগীত। এ থেকেই তাকদীরকে অন্যান্য বাংলাদেশি টিভি শো থেকে আলাদা করে ফেলা যায়। নিছক কিছু বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার নয়, এই সিরিজের ওপেনিং স্কোরটি ইন্ট্রো বা সূচনার সাথে একেবারেই মানানসই যুগলবন্দী হিসেবে পর্দায় উপস্থিত হবে। ইন্ট্রোর এ বিষাদগ্রস্ততা যেন দর্শককে তখনই আগমনী বার্তা দিচ্ছে, সামনে কী ঘটতে চলেছে!  

শুরু থেকেই তাকদীর দর্শককে পর্দার সাথে জড়িয়ে রাখবে। তাকদীর দর্শককে সস্তা ছলের মাধ্যমে ধরে রাখার চেষ্টা করবেনা বরং সুকৌশলে একটু একটু করে গল্পের সাথে মিশে যেতে সাহায্য করবে। গল্পটা এক লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যানের ড্রাইভারকে নিয়ে, তাকদীর তার নাম, যিনি গোরস্থানে দাফনের জন্য মৃতদেহ পৌঁছে দেন। রোজকার মতই গোরে যাবার পথে, একদিন তিনি তাঁর গাড়িতে একটি অজ্ঞাতনামা লাশ খুঁজে পান। 

এই লাশটিকে ঘিরেই গল্প এগিয়ে যায় এবং প্রতিটি চরিত্র এক অনিবার্য কুণ্ডলীর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়তে থাকে। গল্প যতই এগিয়ে যায়, ততই যেন এই গোলকধাঁধার ঘূর্ণিতে জড়িয়ে থাকা চরিত্রগুলো একটু একটু করে লাশটি খুঁজে পাবার চেষ্টা করতে থাকে।

পুলিশ, ভাড়াটে গুণ্ডা এবং অন্যান্য সব চরিত্র এই মৃতদেহের পেছনে পড়ে থাকে আর অন্যদিকে সেখানে তাকদীর এবং তাঁর সারোগেট মন্টু এসবের বাইরে নিজেদের মুক্ত করার চেষ্টায় থাকে।

তাকদীরের চিত্রনাট্য অনেকটাই দর্শককে পশ্চিমা ক্রাইম থ্রিলার যেমন জোডিয়াক বা কোরিয়ান থ্রিলার মেমরিজ অব মার্ডারের একটা আবহ দেবে। গল্পটি এতটাই বাঁকের ভেতর দিয়ে যাবে যে, দর্শক তাঁর আসন ছেড়ে উঠবেন সে জো নেই! তাই বলে আজকাল ওয়েব সিরিজ বলতেই চোখের সামনে যে ইমেজটি ভেসে ওঠে তার সাথে তাকদীরকে মেলানো যাবে না।

পূর্বে অনেক ওয়েব সিরিজই তারকাবহুল হবার পরেও মানসম্মত স্ক্রিপ্ট অথবা বিতর্কিত সমাপ্তির জন্য শেষ পর্যন্ত মুথ থুবড়ে পড়ার উদাহরণ রয়েছে।

তাকদীর এই তালিকার উর্ধ্বে। পুরো সিরিজ জুড়ে তাকদীরের দর্শককে যে স্নায়ুচাপের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে তার সাথে এর ক্লাইম্যাক্স পুরোপুরি সুবিচার করতে পেরেছে।

শেষ দৃশ্যে চঞ্চল চৌধুরীর স্বগতোক্তির অভিনয়ের সময়েও চোখের পানি আটকে রাখতে পারেনি দর্শক। তিনি যেভাবে হৃদয় নিংড়ে এই তথাকথিত ভদ্র, সভ্য, সুশীল সমাজের নিষ্ঠুরতা এবং ভণ্ডামির বিবরণ দিয়ে গেছেন তা দর্শকদের মনে সুতীব্র আঘাত হানতে বাধ্য। দর্শকেরা প্রত্যেকে এই সমাজের একেকজন প্রতিনিধি, তাই চঞ্চলের অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তারা যেন সমাজের আয়নায় নিজেদেরকেই দেখতে পেয়েছেন।

পর্দায় যতটা সময় জুড়ে ছিলেন অভিনেতাদের প্রত্যেকেই মুগ্ধ করেছেন তাদের অভিনয়শৈলীর মাধ্যমে। পার্থ বড়ুয়া অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ভাড়াটে খুনীর চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর সংলাপগুলো কখনো হাস্যরসের খোরাক জুগিয়েছে আবার কখনো মননে চিন্তার উদ্রেক করেছে; তবে প্রতিটি সংলাপ ছিল কাহিনীর সাথে যুতসই। সানজিদা প্রীতিও সাংবাদিকের চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন।

মনোজ প্রামাণিক ‘রানা’ চরিত্রের মাধ্যমে জীবনের প্রতি হতাশা এবং নিরন্তর ছুটে চলার বিভ্রান্তিকে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে চিত্রায়িত করেছেন।

সবশেষে যার কথা না বললেই নয়, তিমি চঞ্চল চৌধুরি। বড় পর্দার মিসির আলীই হন কিংবা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের নিতান্ত সাধারণ একজন লাশবাহী ভ্যানের ড্রাইভার- সকল ভূমিকায় তিনি অকপট। তাকদীর,  বিশেষ কেউ নন, সাধারণ একজন মানুষ। জীবনের প্রতি তাঁর কোন উচ্চাশা নেই, সহজভাবে বেঁচেবর্তে থাকতে পেরেই যিনি সন্তুষ্ট। তাকদীরের মাধ্যমে তিনি যেভাবে জীবনের হতাশা ফুটিয়ে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের আর কোন অভিনেতা তা পারতেন কিনা সে সংশয় থেকে যায়।

তবে গুণকীর্তন এখানেই থামিয়ে দিলেই চলছে না। এই পরিবেশনার সবচেয়ে বড় আবিষ্কার মন্টু চরিত্রে অভিনয় করা সোহেল মন্ডল। তাকদীরের একজন সারোগেট এই মন্টু। গল্প তাকদীরের হলেও মানুষ এই মন্টুর সহজাত- স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় মনে রাখবে অনেক দিন।

ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক নিয়ে আগেই বলেছি। নিছক বিনোদনের উদ্দেশ্যেই নয়, এই ড্রামার সংগীত দর্শকের আবেগের পরিপূরক হয়ে কানে বাজবে।

বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজ নির্মাণে হাতেখড়ি হলো সদ্যই। সময়ের হিসেবে বলা যায়, তাকদীর দর্শককে অনুযোগের তেমন কোন সুযোগ দেবে না। তাকদীরের বাণিজ্যিক সাফল্য অবশ্যই একটি স্মরণীয় কীর্তি হিসেবে বিবেচিত হবে এবং আসছে দিনগুলোতে বাংলাদেশি নাটকের জগতে নতুন এক মানদণ্ড এটি ইতিমধ্যেই তৈরী করে দিয়েছে। এর সাফল্যের পথ ধরে সামনে অনেক মানসম্মত নাটক এবং সিরিজ বাংলাদেশি নির্মাতা এবং অভিনয়শিল্পীদের কাছ থেকে আসতে চলেছে, সেই আশা কিন্ত দর্শকেরা ইতিমধ্যে দেখতে শুরু করেছেন। 

আরো সংবাদ