স্বাধীনদেশ টেলিভিশন

মডেল-নায়িকারাও আসতেন নেহার ডিজে পার্টিতে!

রাজধানী বনানীর একটি বাড়ির বাইরের অংশ দেখতে পুরনো হলেও ওই বাড়িটির ভেতরের ৪র্থ তলায় রয়েছে একটি প্রোডাকশন হাউস। সেই প্রোডাকশন হাউসের আড়ালে চলে প্রাইভেট ডিজের আসর। যেখানে অংশগ্রহণ করে উঠতি মডেল থেকে শুরু করে নামকরা নায়িকারাও। পাশাপাশি আসেন বিত্তবানদের সন্তান থেকে শুরু করে সমাজের নামীদামি ব্যক্তিরা।

ওই প্রোডাকশন হাউসে সপ্তাহের প্রায় ৩ থেকে ৪ দিন বসত ডিজের আসর। সেখানে ডিজে আসরের পাশাপাশি অনৈতিক কর্মকাণ্ডও চলে। ওই আসরে গেস্টদের ডেকে নিয়ে এসে ভিডিও ধারণ করে করা হতো ব্ল্যাকমেইলও। শুধু এ বাড়িতেই নয়, বনানীর মতো গুলশান ও নিকেতনের প্রায় শতাধিক বাড়িতে প্রতিনিয়তই বসে এসব ডিজে আসর।

এ ধরনের সব প্রোডাকশন হাউসে ডিজের পাশাপাশি চলে অনৈতিক কর্মকাণ্ড। সেখানে একটি চক্র ডিজের আসর বসিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর এ সব ডিজে পার্টিতে কোনো রকম নিয়মের তোয়াক্কা না করেই মদ ও উদ্যাম নৃত্যের পাশাপাশি চলে অনৈতিক কর্মকাণ্ড।

সম্প্রতি রাজধানীর একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মদপানে মারা যায়। এরপর থেকে রাজধানীতে অভিযানে নামে পুলিশ; আর তাতেই উঠে আসে এসব তথ্য। গুলশান, বনানী, নিকেতন, উত্তরা এলাকায় পুলিশ এ সব ডিজের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। বিশেষ করে এ রকম প্রাইভেট ডিজের বিরুদ্ধে পুলিশ সক্রিয় রয়েছে। পোশাকে ও সাদা পোশাকেও নজরদারি করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী গণমাধ্যমকে বলেন, এ এলাকাগুলোতে এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধে পুলিশ বদ্ধ পরিকর। আমরা এরইমধ্যে নজরদারি শুরু করেছি। অনেক স্থানে অভিযানও হয়েছে।

উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার শহিদুল্লাহ বলেন, উত্তরার বিভিন্ন এলাকায় এ রকম প্রাইভেট ডিজের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। যেখানেই এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের খবর পাওয়া যাবে সেখানেই আমরা অভিযান চালাব।

পুলিশের অনুসন্ধানে জানা গেছে, হলি আর্টিজানে হামলার পর গুলশানের অভিজাত এলাকা কেন্দ্রিক এ ধরনের পার্টি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে একটি চক্র প্রাইভেট আয়োজন শুরু করে। স্বল্প পরিসরে লোকজন আমন্ত্রণ করে পার্টির আয়োজন করত। পার্টিগুলোতে মূলত বিত্তবানদের ছেলে-মেয়ে ও সমাজের টাকাওয়ালা শ্রেণির লোকজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। পার্টিতে মদ ও ডিজেদের দ্বারা উদ্যম নৃত্যের ব্যবস্থাও থাকে। অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য সব ব্যবস্থাই করে আয়োজকরা।

পুলিশের অনুসন্ধানে জানা গেছে, করোনাকালে মদ আমদানিতে কিছুটা ভাটা পড়লে অসাধু ব্যবসায়ীরা ভেজাল মদ তৈরি করতে শুরু করে। আর এ সব মদ রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে ভেজাল মদ পানে একেক করে মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। গত এক মাসে রাজধানীসহ সারাদেশে অর্ধশতাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ভেজাল মদপানে।

সর্বশেষ পার্টিতে গিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় টনক নড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। একদিকে যেমন ভেজাল মদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়, তেমনি শুরু হয় ডিজের নামে অনৈতিক পার্টির বিরুদ্ধেও। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় ইতোমধ্যে পুলিশের অভিযানে আটক হয় ডিজে নেহা নামের এক তরুণী।

রিমান্ডে আনার পর অনৈতিক এ পার্টি সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য আসে। কীভাবে পার্টি আয়োজনের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতানো যায়। ডিজে নেহা আটকের পর ও পুলিশি অভিযানে রাজধানীর অধিকাংশই স্থানে এখন এ প্রাইভেট ডিজে বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রিক এ ধরনের চক্রের বড় আয়োজন থাকলেও সেটি করতে পারবে কি না সেটি নিয়ে তারা সন্দিহান।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ডিজে নেহার মতো এ রকম শতাধিক তরুণী বা ডিজের অন্ধকার জীবন রয়েছে। যারা রাতের বেলায় এ রকম পার্টিতে মত্ত থাকে আর দিনের বেলায় ঘুমান। এদের কাজই হলো বিত্তবানদের টার্গেট করে পার্টিতে গেস্ট করা। নানা কলা কৌশলে এ ধরনের গেস্টের কাছ থেকে টাকা হাতানোই মূল কৌশল। এজন্য নিজের দেহ বিলাতেও তারা দ্বিধা করে না। আবার অনেক সময় পার্টিতে ডেকে এনে গোপনে ভিডিও ধারণ করে পরবর্তীতে ব্ল্যাক মেইলও করা হয়।

এদিকে গত ৭ ফেব্রুয়ারি নেহাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে নিজের অন্ধকার জগৎ সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন তিনি। রিমান্ডের তৃতীয় দিনে ডিজে নেহার ফোনবুকে পুলিশ ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ডজনখানেক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীর নম্বর পেয়েছে। যেগুলো সাংকেতিকভাবে সংরক্ষণ করা। এসব ধনাঢ্যের অনেকের কাছে মদ, মেয়ে সরবরাহ করতেন তিনি। কখনো কখনো নেহা নিজেই তাদের সঙ্গ দিয়েছেন। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে পেয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, ডিজে নেহার পছন্দের মোবাইল ফোনে (আইফোন) টার্গেট করা ব্যবসায়ী ও ধনী যুবকদের নম্বর ‘ক্লায়েন্ট-১’, ‘ক্লায়েন্ট-২’, ‘ক্লায়েন্ট-৩’ এমন ধারাবাহিকভাবেই সংরক্ষণ করা আছে। কারো কারো নাম সংক্ষেপে প্রথম বর্ণ দিয়েও সংরক্ষণ করা।

জিজ্ঞাসাবাদে নেহা জানিয়েছেন, গত বছরের মার্চে চট্টগ্রামের এক গাড়ি ব্যবসায়ীর সঙ্গে একটি পার্টিতে তার পরিচয় হয়। এরপর ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে কৌশলে ছয় মাসে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন নেহা। এরইমধ্যে ওই গাড়ি ব্যবসায়ীর এক ফেসবুক বন্ধুর সঙ্গেও পরিচয় হয় নেহার। সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত নেহা ঢাকার ওই গাড়ি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি হাতিয়েছেন। নেহার ব্যবহৃত এক লাখ ৩৭ হাজার টাকা দামের আইফোন টুয়েলভ প্রো ম্যাক্স ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকেই নেওয়া। এভাবেই আরও অনেক ব্যবসায়ীকে মাদক ও নারী সঙ্গের জালে জড়িয়েছিলেন নেহা।

নেহার এসব কাজে সহযোগিতা করতেন তারই চাচাতো ভাই শাফায়াত জামিল বিশাল। বিশাল সার্বক্ষণিক নেহার সঙ্গেই থাকতেন।

গত ২৮ জানুয়ারি উত্তরার ব্যাম্বু স্যুট রেস্টুরেন্টে মদপান করাতে নেহা ও তার খুব কাছের বন্ধু আরাফাত পার্টির আয়োজন করেন। মদপানের পর অসুস্থ হয়ে আরাফাতও মারা গেছেন। সেদিন নেহার ফোনেই তার চাচাতো ভাই শাফায়াত জামিল ওরফে বিশাল এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে মদ কিনে নিয়ে যায় ওই রেস্টুরেন্টে।

নেহা পুলিশকে জানিয়েছেন, খদ্দেরদের তালিকা সংরক্ষণ করতেন বিশাল। এছাড়া অবৈধ দরদামে তিনি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর মৃত্যুর পর তার বাবার মামলায় অজ্ঞাত আসামি হিসেবে নিজেই আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন বিশাল। পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। এছাড়া ওই ছাত্রীর ছেলে বন্ধু আরিফ এবং তাদের বাসায় আশ্রয়দাতা তাফসিরও কারাগারে আটক রয়েছেন।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি হারুন অর রশিদ জানান, নেহাকে জিজ্ঞাসাবাদে আমরা অনেক তথ্য পেয়েছি। এসব যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

এর আগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি নেহা আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, গত ২৮ জানুয়ারি আমার বন্ধু আরাফাতের নিমন্ত্রণে উত্তরার ব্যাম্বুসুট রেস্টুরেন্টে যাই। সেখানে গিয়ে আরো কয়েকজনকে দেখতে পাই। আমি আরাফাত ছাড়া অন্য কাউকে চিনতে পারিনি। সেখানে আমি মদপান করি। তিন পেগ পান করার পর আমার মুখ দিয়ে রক্ত বের হয় এবং বমিও হয়। আমি তখন সেখান থেকে বাসায় চলে যাই। বাসায় যাওয়ার পরও আমার কয়েক দফা বমি হয়। এমন পরিস্থিতিতে আমি হাসপাতালে চিকিৎসা নেই।

ওই ছাত্রী মারা যাওয়ার ঘটনায় করা ধর্ষণ ও হত্যা মামলার সব আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সব ফরেনসিক রিপোর্ট পেলে পুলিশ মামলার চার্জশিট জমা দেবে।

আরো সংবাদ