স্বাধীনদেশ টেলিভিশন

পুরুষদের অভিবাসন ব্যয় বাড়লেও কমছে নারীদের!

পুরুষদের অভিবাসন ব্যয় বাড়লেও কমছে নারীদের। এক সময় নারীরা বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা খুব কম থাকলেও ২০০৪ সাল থেকেই তা বাড়ছে। আর ২০১৫ সালে সৌদি আরবের শূন্য অভিবাসন ব্যয়ে বিদেশে যাওয়ার সুযোগের পর থেকে এটা নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। যদিও নারী অভিবাসনের ক্ষেত্রে এখনও সামাজিক বাধা রয়েছে। আর এ কারণে ঢালাওভাবে প্রবাসী নারীদের বিষয়ে নেতিবাচক প্রচারণা না করে ইতিবাচক ঘটনাও তুলে ধরতে হবে।

বৃহস্পতিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) নারী অভিবাসন বিষয়ক এক ওয়েবিনারে তুলে ধরা জরিপের ফলাফলে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। ওয়েবিনারে নারী অভিবাসন নিয়ে মতামত তুলে ধরেন বক্তারা। ইকনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ), গবেষণা সংস্থা র‍্যাপিড ও দৃষ্টি রিচার্স সেন্টার যৌথভাবে এ ওয়েবিনারের আয়োজন করে।

‘বাংলাদেশের অভিবাসন ও লিঙ্গ : একটি অনিয়মিত প্রকৃত দৃশ্যপট’ শীর্ষক ওয়েবিনারে পাঁচটি জেলার ওপর পরিচালিত জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন- প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন। ইআরএফ সভাপতি শারমিন রিনভীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম।

বক্তারা বলেন, অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি প্রবাসী আয়। ধীরে-ধীরে নারী অভিবাসন বাড়লেও যথাযথ তথ্যের অভাবে বিদেশে গিয়ে নির্যাতন ও ঝুঁকির মুখে পড়তে হচ্ছে। এ অবস্থায় উত্তর‌ণে নারীদের বিদেশে নেওয়ার আগে কোন কাজের জন্য নেওয়া হচ্ছে সে বিষয়ে প্রকৃত তথ্য দিতে হবে। যে কাজের জন্য নেওয়া হচ্ছে সে বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ থাকতে হবে।

কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, একটি নির্যাতনের ঘটনাও আমরা টলারেট (সহ্য) করি না। তবে যারা বিদেশে যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশ নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি ঠিক না। গত ১০ বছরে অন্তত ৭-৮ লাখ নারী শ্রমিক বিদেশে গেছেন তাদের কত জন নির্যাতিত হয়েছেন? সুতরাং যারা নির্যাতিত হয়েছেন তাদের বিষয়টি হাইলাইটস (দৃষ্টিগোচর) করলে নারী অভিবাসন বাড়ানো যাবে না। সফলতার বিষয়গুলোও সামনে আনতে হবে।

তিনি বলেন, আমি স্বীকার করি, অন্যান্য দেশ বিবেচনায় বাংলাদেশের নারী অভিবাসন খুব কম। এর অন্যতম কারণ আমাদের সামাজিক প্রেক্ষিত। সমাজ বাস্তবতা বিবেচনায় একজন পুরুষ যত সহজে বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, একজন নারী পারেন না। এছাড়া সামগ্রিকভাবে একজনকে দেখাদেখি আরেকজন বিদেশে যান। যে কারণে সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, টাঙ্গাইলের মতো আগে থেকে যেসব এলাকার লোক বাইরে গেছেন, তারাই বেশি বাইরে যাচ্ছেন। আর উত্তরবঙ্গের লোক বাইরে কম যান। এরকম প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী ইশতেহারে প্রত্যেক উপজেলা থেকে যে এক হাজার করে লোক বাইরে পাঠানোর চেষ্টা চলছে। সেখানে পিছিয়ে থাকা এলাকাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বাংলাদেশ অভিবাসনে যাওয়া মোট নারীর ৭৫ শতাংশ থাকেন সৌদি আরবে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান র‌্যা‌পিডের চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক বলেন, ৯০-এর দশকে ৩৫ বিলিয়নের অর্থনীতির বাংলাদেশ এখন ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের দেশ হয়েছে। দেশের অর্থনীতির আকার যতো দ্রুত বেড়েছে, সেভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের মতো বৈশ্বিক চিত্রও এরকম। এখন দেশ থেকে দক্ষ ও শ্রমিক রপ্তানির ওপর জোর দিতে হবে। আমাদের জিডিপিতে ১৩ শতাংশের কম অবদান এখন কৃষির। অথচ কর্মসংস্থানের ৪০ শতাংশের বেশি এ খাতে। এটা ভালো না। প্রতিবছর দেশে ২০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান দরকার হলেও তা হচ্ছে না।

অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দৃষ্টি রিসার্চ সেন্টারের প্রিন্সিপাল থেরেস ব্ল্যান‌চেট। তার নেতৃত্বে পাঁচটি জেলায় পরিচালিত জরিপের ফল তুলে ধরা হয়।

২০১৯-এর ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। বরগুনা, পটুয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও মানিকগঞ্জ জেলার একটি করে ইউনিয়নের মোট ১২৫টি গ্রামের ছয় হাজার ৮৪৮ থানার আট হাজার ৪৩৭ জনের ওপর এ জরিপ করা হয়। যেখানে নারী অভিবাসী ছিলেন এক হাজার ৩২৭ জন বা ১৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর পুরুষ সাত হাজার ১১০ জন।

জরিপের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের মোট জনশক্তির ৩৭ দশমিক ১০ শতাংশ থাকেন সৌদি আরবে। আর মোট নারী অভিবাসীর ৭৫ শতাংশ থাকেন দেশটিতে। পুরুষদের অভিবাসন ব্যয় বাড়লেও নারীদের কমছে। অভিবাসীদের ১৪ শতাংশের মতো নারী বিনা খরচে বাইরে গেছেন। পুরুষদের বেলায় যেখানে অনেক বেশি খরচ করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অভিবাসন ব্যয় হয়েছে কুয়েতে। প্রকৃত খরচের তুলনায় দেশটিতে ৪২১ শতাংশ বেশি ব্যয় হয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাহরাইনে যেতে প্রকৃত খরচের চেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে ৩৮৭ শতাংশ। পর্যায়ক্রমে কাতারে ৩৭২ শতাংশ, ওমানে ৩২৩, লেবাননে ৩১২,  জর্ডানে ৩০৮ সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২৯১ ও সৌদি আরবে ২৮৭ শতাংশ বেশি খরচ হয়েছে।

জরিপের তথ্য তুলে ধরে থেরেস ব্ল্যান‌চেট বলেন, এক সময় বাংলাদেশের অভিবাসন বলতে শুধু পুরুষদের বলা হতো। তবে বাংলাদেশ থেকে মোট ৪৪টি দেশে শ্রমিক যান। এর মধ্যে ২২টি দেশে নারীরা যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে বড় পরিবর্তনটা এসেছে ২০০৪ সাল থেকে। এরপর ২০১৫ সালে সৌদি সরকারের সঙ্গে এক চুক্তির পর ২০১৭ সালে এটি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। পুরুষদের অভিবাসন ব্যয় বাড়লেও নারীদের ক্ষেত্রে ধীরে-ধীরে কমেছে। যেসব নারীরা বিদেশে গেছেন তাদের মধ্যে ৫৫ দশমিক ৮০ শতাংশ আগে গৃহকর্মী ছিলেন। আর ১৬ শতাংশ তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক ছিলেন। তালাকপ্রাপ্ত বা বিধবা নারীদের মধ্যে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেশি।

জরিপে অন্তর্ভুক্ত এসব জেলার মধ্যে নারী পুরুষের অনুপাতে সব চেয়ে বেশি নারী বিদেশে আছেন বরগুনা জেলা থেকে। আর সব চেয়ে কম গেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারীরা। বরগুনা জেলার ২৫১ জন অভিবাসীর মধ্যে নারী ৬৯ জন বা সাড়ে ২৭ শতাংশ। নারায়ণগঞ্জ জেলার এক হাজার ৯৪ জনের মধ্যে ২৬ দশমিক ৪০ শতাংশ ছিলেন নারী। পর্যায়ক্রমে পটুয়াখালীর ৬২৯ জনের মধ্যে ২১ দশমিক ১০ শতাংশ, মানিকগঞ্জের তিন হাজার ৯১৭ জনের মধ্যে ১৮ শতাংশ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুই হাজার ৫৪৬ অভিবাসী মধ্যে পাঁচ দশমিক ১০ শতাংশ নারী বিদেশে গেছেন।

থেরেস বলেন, নতুনভাবে যেসব জেলা থেকে অভিবাসীরা বাইরে যাচ্ছেন, সেখান থেকেই নারীদের বিদেশে যাওয়ার সংখ্যা বেশি। আবার যে পাড়া থেকে একবার বাইরে যান, থেকে যাওয়ার হার বাড়ে। সাধারণভাবে অবিবাহিতদের বাইরে যাওয়ার সংখ্যা কম। অবিবাহিতদের দেশের বাইরে পাঠালেও তার আয় দিয়ে জমি বা অন্য সম্পদ ক্রয়, ছোট ভাই থাকলে তাকে বিদেশে পাঠানোর আশায় সহজে তাকে দেশে আসতে দিতে রাজি হন না বাবা মা। এছাড়া সরকারের একটি আইন আছে বাংলাদেশ থেকে ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী নারীরা বিদেশে যেতে পারবেন। এক্ষেত্রে দালাল চক্র নানা প্রলোভন দেখিয়ে যেকোনো বয়সীদের নিয়ে যান। তারা ১০ হাজার টাকা দিলে সব কাগজ ঠিক করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।

নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবির বলেন, নারীদের বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায় সমাজে নানা নেতিবাচক কথা হয়। এসব বাধা পেরিয়ে যারা বিদেশে যাচ্ছেন তাদের সেবা বাড়াতে হবে।

আরও বক্তব্য রাখেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও র‌্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক ড. এম আবু ইউসুফ, আইএলওর প্রতিনিধি ইগোর বস প্রমুখ।

আরো সংবাদ