স্বাধীনদেশ টেলিভিশন

৯২ বছর বয়সে চলে গেলেন কিংবদন্তি শিল্পী লতা মঙ্গেশকর

বিদায়, সংগীতের সম্রাজ্ঞী

কথাটা কবি ও গীতিকার জাভেদ আখতারের। লতা মঙ্গেশকরকে নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘যদি বিশ্বের সব সুগন্ধি, সব চাঁদের আলো আর সমস্ত মধু একসঙ্গে করা হয়, তারপরও তা লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠের মতো কিছু তৈরি হবে না।’ আর মান্না দে বলেছিলেন, ‘লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে ঈশ্বর বাস করেন।’ আদর করে তাঁকে সুরের জীবন্ত সরস্বতী বলা হতো। আর সরস্বতীর পূজার পরের দিনই চলে গেলেন সংগীতের এই মহাতারকা। ৯২ বছর বেঁচে ছিলেন লতা। এর মধ্যে আট দশকজুড়েই তিনি ছিলেন গানের জগতের প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন সুরসম্রাজ্ঞী। জন্মেছিলেন ভারতে, বেশি গেয়েছেন মূলত হিন্দি গান, কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে শোকে ভাসছেন বাংলাদেশেরও প্রতিটি সংগীতপ্রেমী মানুষ। আনন্দ কিংবা বিষাদে এ অঞ্চলের মানুষ বারবার আশ্রয় নিয়েছেন লতা মঙ্গেশকরের গানে-সুরে-কণ্ঠে। আগামী দিনেও লতা মঙ্গেশকরের গানেই বারবার আশ্রয় নেবেন সংগীতপিপাসুরা। গতকাল রোববার সকাল ৮টা ১২ মিনিটে মধ্য মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যানডি হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। জানুয়ারি মাসের শুরুতে করোনায় আক্রান্ত হন লতা মঙ্গেশকর। ৮ জানুয়ারি থেকে ব্রিচ ক্যানডি হাসপাতালে ছিলেন। একসময় করোনামুক্ত হলেও পরে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। মধ্যে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হয়েছিল। তবে শনিবার শারীরিক অবস্থার আবার অবনতি হয়। শনিবার সন্ধ্যাবেলা বোন লতাকে দেখতে হাসপাতালে যান আশা ভোসলে। তখন থেকে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত সব চেষ্টা ব্যর্থ করে চলে যান লতা মঙ্গেশকর।

জীবনযাপনে লতা

সংগ্রাম করে বড় হয়েছেন, কাটিয়েছেন সাদামাটা জীবন, ছিলেনও মাটির কাছাকাছি একজন মানুষ। লতা মঙ্গেশকর কেবল যে একজন মেধাবী মানুষ ছিলেন, সেটাই শেষ কথা ছিল না—সাধনা, একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতাই ছিল তাঁর আরেক পরিচয়। আজীবন সংগীতেরই মানুষ ছিলেন তিনি। ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এক মারাঠি পরিবারে জন্ম নেন তিনি। বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর নাট্য অভিনেতা ও গায়ক ছিলেন। তখন তাঁর নাম ছিল হেমা। বাবাই নাম বদলে লতা ডাকা শুরু করেন। জীবনে প্রথম বাবার সঙ্গে মঞ্চে ওঠেন মাত্র ৯ বছর বয়সে। তবে মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারানো লতা মঙ্গেশকরকেই পরিবারের পুরো দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। মা ছিলেন, আরও ছিলেন ছোট ছোট চার ভাইবোন—আশা, উষা, মিনা আর হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর। অর্থ আয়ের জন্য সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন ১৩ বছর বয়সে। অভিনয় তাঁর ভালো লাগেনি। গানের জগতেই থেকে গেলেন সেই থেকে। অনেক পরে রাজকাপুর তাঁকে নিয়েই সিনেমা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নিজের জীবনী নিয়ে সিনেমায় অভিনয়েও রাজি হননি তিনি। মারাঠি সিনেমা কিতি হসাল-এ প্রথম গান রেকর্ড করেছিলেন লতা। ১৯৪৫ সালে চলে আসেন মুম্বাই (তৎকালীন বোম্বে)। সেখানে এসে শাস্ত্রীয় সংগীত শিখতে শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে মুক্তি পাওয়া শহিদ সিনেমায় গান গাওয়ার জন্য তিনি দেখা করেন প্রযোজক শশধর মুখার্জির সঙ্গে। কিন্তু ‘কণ্ঠ বড় বেশি সরু’—এ কথা বলে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন লতাকে। এর পরের আট দশকে সেই সরু কণ্ঠেই মজে ছিলেন ভক্তরা। লতা সংগীত পরিচালক গুলাম হায়দারকে আজীবন ‘গডফাদার’ মেনে এসেছেন। সবাই যখন বাতিল করে দেন সরু কণ্ঠের লতাকে, তখন গুলাম হায়দারই প্রথম হিন্দি সিনেমার জন্য তাঁর গান রেকর্ড করান। গুলাম হায়দারের বিশ্বাস ছিল, একদিন লতাই সংগীতজগতে রাজত্ব করবেন। আর তাই প্রথম রেকর্ডের দিন গুলাম হায়দার নওশাদ ও অনিল বিশ্বাসের মতো বড় বড় সংগীত পরিচালককে আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছিলেন। বিখ্যাত পরিচালক কামাল আমরোহীর প্রথম সিনেমা ছিল মহল। অশোক কুমার ও মধুবালা অভিনীত মহলকে বলা হয় ভৌতিক ঘরানার প্রথম হিন্দি সিনেমা। সেই সিনেমায় গান গাইলেন লতা। সুরকার ছিলেন খেমচাঁদ প্রকাশ। লতার গাওয়া ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ হলো সুপারহিট। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি লতাকে। দেশ ভাগ হলে ১৯৪৭ সালেই নূরজাহান চলে যান পাকিস্তানে। তখন ধারণা করা হয়েছিল, হিন্দি সিনেমা জগতে এমন এক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যা কখনো পূরণ হবে না। শূন্যস্থান তো পূরণ হলোই, বলা যায় সবাইকে ছাড়িয়ে যান লতা। যদিও প্রথম দিকে অভিযোগ ছিল, লতা নূরজাহানকে অনুসরণ করলেও তাঁর উর্দু উচ্চারণ ভালো নয়। স্বয়ং দিলীপ কুমার এ কথা বলেছিলেন বলে প্রচলিত আছে। এরপর লতা উর্দু শিখেছিলেন, আর শুরুতে নূরজাহানকে অনুসরণ করার কথা তো নিজেই স্বীকার করেন।

খ্যাতির গগনে

কোকিলকণ্ঠী লতাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি ঠিকই, তবে সংগ্রাম করতে হয়েছে আজীবন। আরেক কিংবদন্তি সংগীত পরিচালক এস ডি বর্মনের সঙ্গে লতা কোনো গান করেননি ১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। সে সময় এস ডি বর্মনের নারীকণ্ঠের প্রায় সব গানই গেয়েছেন লতারই বোন আশা ভোসলে। আবার রয়্যালটি প্রশ্নে মতভিন্নতা হলে ষাটের দশকেই দীর্ঘ সময় গান গাননি মোহাম্মদ রফির সঙ্গে। আবার আজীবন কোনো অশ্লীল শব্দ বা ভাবধারার কোনো গানেও কণ্ঠ দেননি তিনি। তারপরও লতা আজীবনই থেকে গেছেন খ্যাতির মধ্যগগনে। লতার কণ্ঠে সেরা সব গানের কথা লেখা সহজ নয়, সম্ভবও নয়। তাঁর অপূর্ব ও মধুর কণ্ঠে গাওয়া মধুমতির ‘আজা রে পরদেশি’, ক্ল্যাসিক্যাল ঢঙে গাওয়া পাকিজার ‘চলতে চলতে ইউ হি কোই মিল গ্যায়া’, দিল আপনা প্রিত পরাই-এর ‘আজিব দস্তান হ্যায় ইয়ে’, গাইড–এর ‘আজ ফির জানে কি তামান্না হায়’, মুঘল-ই-আজম–এর ‘জব পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া’, অনুপমার ‘কুছ দিল না কাহা’ বা ও কোন থি সিনেমার ‘লাগ জা গলে’—এসবই ষাট আর সত্তরের দশকের এক একটি মুক্তা। নাসরীন মুন্নি কবিরের লেখা জীবনীতে লতা বলেছেন, ১৯৬২ সালে তাঁকে বিষ খাইয়ে মারার চেষ্টা হয়েছিল। অসুস্থ হয়ে তিন মাস তিনি বিছানাবন্দী ছিলেন। ফিরে এসেই গাইলেন বিশ সাল বাদ সিনেমার সেই রহস্য গলার গান, ‘কাহি দীপ জ্বালে কাহি দিল’। আবার একসময় বলা হয়েছিল লাস্যময়ী গলার গান লতা গাইতে পারেন না। ইন্তেকাম সিনেমায় ‘আ জানে যা’ গান গেয়ে সেই প্রমাণ দিয়ে আর এ ধরনের গানে তেমন আগ্রহ দেখাননি। ১৯৬৩ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের সময় লতা গাইলেন, ‘ইয়ে মেরে ওয়াতন কি লোগো’। এ গান শুনে কেঁদেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। আজও ভারতের যেকোনো সংকটেই সবচেয়ে বেশি শোনা যায় এই গানই।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে হিন্দি চলচ্চিত্রজগতে পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। সম্পূর্ণ নতুন এক প্রজন্মের দখলে চলে যায় হিন্দি সিনেমা। কিন্তু লতা থেকে গেছেন তাঁর নিজের জায়গায়। রাজ কাপুরের সত্যম শিবম সুন্দরম বা বাজার সিনেমার ‘দিখাইয়ে দিয়ে ইউ কে বেখুদ কিয়া’র মতো গান তো আছেই, এমনকি হাম আপকা হ্যায় কউন–এর ‘দিদি তেরা দেওর দিওয়ানা’, দিলওয়ালে দুলহানিয়া…সিনেমার ‘তুজে দেখা তো’, ১৯৪২: এ লাভ স্টোরির ‘কুছ না কহো’ বা রাং দে বাসন্তীর ‘লুকা চুপি বহুত হুয়া’—আছে এ রকম অসংখ্য উদাহরণ।

বাংলা গানের লতা
প্রায় ৪০টি ভাষায় গান গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। তবে ভালোবাসতেন বাংলা গান গাইতে। প্রথম বাংলা গান গেয়েছিলেন ১৯৫৬ সালে, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘আকাশপ্রদীপ জ্বেলে’। প্রথম গানই সুপারহিট। পরিসংখ্যান বলছে, এরপর তিনি ১৮৫টি গান বাংলা গান রেকর্ড করেন। এ জন্য তিনি সব সময় স্মরণ করেছেন সুরকার সলীল চৌধুরী ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। একসময় হেমন্তকে নিয়ে কিছু গুজব ছড়ালেও লতা আজীবন তাঁকে ভাই বলেই মনে করেছেন। ‘যারে উড়ে যারে পাখি’, ‘না যেয়ো না’, ‘নিঝুমও সন্ধ্যায়’—এ রকম অসংখ্য বিখ্যাত বাংলা গান গেয়েছেন লতা।

ব্যক্তিজীবনে লতা
বিয়ে করেননি লতা। তবে গুঞ্জন আছে যে ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের (বিসিসিআই) সাবেক সভাপতি প্রয়াত রাজ সিং দুঙ্গারপুরের সঙ্গে তাঁর প্রেম ছিল। তবে লতা তা কখনোই স্বীকার করেননি। বরং ভালো বন্ধুত্বের কথা বলেছেন। লতার ক্রিকেটপ্রেম এই বন্ধুর কারণেই। আর ক্রিকেট জগতে তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আরেক কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকার। শচীন লতাকে মা বলতেন।
লতার ভাইবোনেরাও সংগীতজগতের মানুষ। একসময় বোন আশার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা ছিল। এসব পরে আর থাকেনি। ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের সুরে গেয়েছেন ‘ইয়ারা সিলি সিলি’সহ লেকিন সিনেমার বিখ্যাত সব গান।
লতা নিজেও একসময় গোপনে সংগীত পরিচালনা করতেন। তিনি চাননি এ তথ্য কেউ জানুক। সমস্যা দেখা দেয় ১৯৬৫ সালে মারাঠি সিনেমা সাধি মানসে সেরা সংগীত পরিচালকসহ আটটি বিভাগে মহারাষ্ট্র রাজ্য পুরস্কার পেয়ে যাওয়ায়। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রথমে সেরা গায়িকার পুরস্কার নেন লতা। সেরা সিনেমায় সংগীত পরিচালকের নাম ছিল ‘আনন্দঘন’। মঞ্চে বারবার নাম ঘোষণা করা হলেও কেউ পুরস্কার নিচ্ছিলেন না। তখন উপস্থাপক লতার নাম বলে দিলে বিষয়টি জানাজানি হয়।

বাংলাদেশের পাশে

লতা মঙ্গেশকরের দরদ ছিল বাংলাদেশের প্রতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় শুরু থেকেই বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছেন, পাশে থেকেছেন এবং নানা ধরনের কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ সহায়তা তহবিলে এক লাখ টাকা অর্থসহায়তা করেছিলেন।
মূলত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তার জন্য ভারতীয় অনেক শিল্পীই এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁরা গান গেয়ে তহবিল সংগ্রহের পাশাপাশি গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাপী সচেতনতা। ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর মুম্বাইয়ের ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের সমর্থনে একটি বড় তারকা সমাবেশ হয়েছিল। সেই সমাবেশে লতা মঙ্গেশকর গান গেয়েছিলেন। সমাবেশে আরও ছিলেন আশা ভোসলে, কিশোর কুমার, মোহাম্মদ রফি, মান্না দে, মহেন্দ্র কাপুর, শচীন দেববর্মনসহ হিন্দি চলচ্চিত্র ও সংগীতজগতের প্রখ্যাত সব শিল্পী।
স্বাধীনতা অর্জনের পরেও লতা মঙ্গেশকর ১৯৭২ সালে প্রখ্যাত অভিনেতা সুনীল দত্তের নেতৃত্বে ভারতের একটি সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছিলেন। ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর লতা মঙ্গেশকর এ টুইট বার্তায় সে কথা স্মরণও করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘নমস্কার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হতেই আমি সুনীল দত্তের গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশ গিয়ে অনেক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলাম। সে সময়ে সেনাবাহিনীর উড়োজাহাজে করে সব জায়গায় গিয়েছিলাম।’
লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণে সংগীতজগৎ তাঁর সম্রাজ্ঞীকেই হারাল। তবে সিনেমার সমালোচনা লিখে জাতীয় পুরস্কার পাওয়া, আউটলুক ইন্ডিয়ার সিনিয়র এডিটর গিরিধর ঝা লতার চলে যাওয়া নিয়ে যা লিখেছেন, সেটাই বরং মনে করি। তিনি লিখেছেন, ‘হিন্দি সিনেমা জগতেরই ভাগ্য যে তারা একজন লতা মঙ্গেশকর পেয়েছিল।’লতা চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর গান থেকে যাবে যুগ যুগ ধরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

আরো সংবাদ