চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের সঙ্গে দেশটির আচরণের নিন্দা জানিয়েছে অন্তত ৩৯টি দেশ। একই সঙ্গে হংকংয়ের বেইজিং নীতির কড়া সমালোচনা করেছে দেশগুলো। গত ৬ অক্টোবর জাতিসংঘে মানবাধিকার-সংক্রান্ত এক বৈঠক থেকে এ নিন্দা জানানো হয়। তবে এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে চীন। খবর: আল-জাজিরা।
মূলত জার্মানির উদ্যোগে জিনজিয়াং ও হংকংয়ে চীনের আচরণের নিন্দা জানানোর এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাপানের মতো দেশগুলোও শামিল হয় বার্লিনের এ উদ্যোগে। সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের অধিকারের প্রতি সম্মান জানাতে বেইজিংয়ের প্রতি আহ্বান জানান জাতিসংঘে নিযুক্ত ৩৯টি দেশের প্রতিনিধিরা। এছাড়া হংকং পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানান তারা।
জাতিসংঘে নিযুক্ত জার্মানির দূত ক্রিস্টোফ হিউজেন বলেন, ‘জিনজিয়াংয়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও হংকংয়ের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’ জিনজিয়াংয়ে অবিলম্বে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের অর্থপূর্ণ ও নিরবচ্ছিন্ন প্রবেশাধিকার দিতে বেইজিংয়ের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
নিচে জিনজিয়াং ও হংকংয়ে চীনের আচরণের নিন্দা জানিয়ে দেওয়া বিবৃতিতে স্বাক্ষর করা দেশগুলোর অধিকাংশই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করা ৩৯টি দেশ হচ্ছেÑআলবেনিয়া, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, বসনিয়া হার্জেগোভিনা, বুলগেরিয়া, কানাডা, ক্রোয়েশিয়া, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, হাইতি, হন্ডুরাস, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, জাপান, লাটভিয়া, লিচেনস্টেইন, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, রিপাবলিকান অব মার্শাল আইল্যান্ডস, মোনাকো, নাউরু, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, উত্তর মেসোডোনিয়া, নরওয়ে, পালাউ, পোল্যান্ড, স্লোভেনিয়া, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি। বিবৃতিতে হংকংয়ের বিতর্কিত নিরাপত্তা আইনের মধ্যেও অঞ্চলটির বাসিন্দাদের অধিকার ও স্বাধীনতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের উদ্যোগে এমন একটি খসড়ায় স্বাক্ষর করে ২৩টি দেশ। এবার সে সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণের মতো বাড়ল। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আশঙ্কা, চীনের বন্দিশিবিরগুলোয় ১০ লাখেরও বেশি উইঘুর মুসলিমকে বিনা বিচারে আটক করে রাখা হয়েছে। তবে সংবাদমাধ্যম উইঘুর টাইমস বলছে, এসব শিবিরে প্রকৃত বন্দির সংখ্যা ৩০ লাখ।
এদিকে জার্মানিসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর এমন প্রতিক্রিয়াকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে বেইজিং। জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি জাং ঝুন এই বিবৃতিকে উসকানিমূলক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
চীনে প্রায় দেড় কোটি উইঘুর মুসলমানের বাস। জিনজিয়াং প্রদেশের জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশই উইঘুর মুসলিম। এ প্রদেশটি তিব্বতের মতো স্বশাসিত একটি অঞ্চল। বিদেশি মিডিয়ার সেখানে প্রবেশের ব্যাপারে কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সূত্রে খবর আসছে, সেখানে বসবাসরত উইঘুরসহ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ওপর ব্যাপকভাবে ধরপাকড় চালাচ্ছে বেইজিং। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও জাতিসংঘের কাছে এ ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছে। চীন বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
উইঘুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নকে ‘সন্ত্রাস ও চরমপন্থা’র বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে আখ্যায়িত করে বেইজিং। ২০১৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি চীন সফরে গিয়ে দেশটির উইঘুর নীতির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফাঁস হওয়া দলিলে চীনে উইঘুর মুসলমানের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের চিত্র উঠে আসে। এসব দলিলে জিনজিয়াং অঞ্চলে তিন হাজারের বেশি উইঘুরের দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় খুঁটিনাটিসহ ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
উইঘুর জাতিগোষ্ঠীর বেশিরভাগই মুসলমান। তাদের মুখাবয়ব, ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে চীনের প্রধান জাতিগোষ্ঠী হানের চেয়ে বরং মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সাদৃশ্য বেশি। তবে গত কয়েক দশকে লাখ লাখ হান চাইনিজ জিনজিয়াংয়ে বসতি গড়ে তুলেছে। এর পর থেকে ক্রমেই সেখানে এক ধরনের জাতিগত উত্তেজনা তৈরি হয়। উইঘুরদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে, এমন আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। এ নিয়ে মাঝেমধ্যেই সেখানে বিক্ষোভ-সংঘাতের ঘটনা ঘটে। তবে বেইজিং এসব বিক্ষোভ ‘কঠোরভাবে দমন’ করে থাকে।