স্বাধীনদেশ টেলিভিশন

করোনায় আক্রান্ত যাত্রীও আসছে আকাশপথে !

দেশে-বিদেশে করোনা মহামারি ফের মাথাচাড়া দেওয়ায় তা মোকাবেলায় সরকার যখন ব্যাপক তৎপর, তখনো আকাশপথে চলছে চরম গাফিলতি। করোনা নেগেটিভ সনদ ছাড়া কোনো যাত্রী আনা যাবে না, আনলে জরিমানার পাশাপাশি ফ্লাইট বন্ধ—এমন কঠোর নিষেধাজ্ঞার পরও সনদ ছাড়া যাত্রী আসছে, আসছে করোনা পজিটিভ যাত্রীও।

গত ১০ দিনে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পাঁচজন করোনা পজিটিভ যাত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। একই সময়ে বিভিন্ন ফ্লাইটে করোনা নেগেটিভ সনদ ছাড়া এক হাজার ৪০ জন যাত্রী এসেছে, যাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে পাঠিয়েছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। এভাবে বিদেশ থেকে নেগেটিভ সনদ ছাড়া যাত্রী আসা বন্ধ না হলে করোনা পরিস্থিতির আবারও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশি-বিদেশি ১০টি এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে সনদ ছাড়া ওই যাত্রীরা এসেছে। এর মধ্যে সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনস, এয়ারএশিয়া ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে করোনায় আক্রান্ত যাত্রী এসেছে। এই তিন এয়ারলাইনসকে জরিমানা করা হলেও সনদ ছাড়া যাত্রী আসা থামছে না। গত ২৪ ঘণ্টায় আরো সাতজন যাত্রী করোনা সনদ ছাড়া দেশে এসেছে।

বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, সংশ্লিষ্ট দেশের এয়ারপোর্ট থেকে কঠোরভাবে যাচাই-বাছাই না করেই বোর্ডিং কার্ড ইস্যু করা হচ্ছে, পরে তারা দেশে এসে ধরা পড়ছে। আবার কেউ কেউ পিসিআর টেস্টের কথা বলে অন্য টেস্ট নিয়ে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) অভিযুক্ত এয়ারলাইনসকে শুধু জরিমানাই নয়, ফ্লাইট বন্ধের নির্দেশনাও জারি করেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইউরোপ-আমেরিকার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যাতে বাংলাদেশে আছড়ে পড়তে না পারে, সে জন্য সতর্কতামূলক কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। সে অনুযায়ী, ৫ ডিসেম্বর থেকে বিদেশফেরত যাত্রীদের কভিড নেগেটিড সনদ বাধ্যতামূলক করে বেবিচক। এর ফলে দেশে আসতে চাইলে অবশ্যই ৭২ ঘণ্টা আগের করোনামুক্তির সনদ লাগবে, কিন্তু এর পর থেকে প্রতিদিনই বিভিন্ন এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে সনদ ছাড়াই যাত্রী দেশে আসছে।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সূত্র জানায়, করোনা সনদ ছাড়া গত ৫ ডিসেম্বর ৩০৪ জন, ৬ ডিসেম্বর ১৯৫ জন, ৭ ডিসেম্বর ২৩৫ জন, ৮ ডিসেম্বর ৮০ জন, ৯ ডিসেম্বর ৪৮ জন, ১০ ডিসেম্বর ১১৮ জন, ১১ ডিসেম্বর ৩০ জন, ১২ ডিসেম্বর ২৩ জন, ১৩ ডিসেম্বর ৪ জন এবং ১৪ ডিসেম্বর বিকেল পর্যন্ত তিনজনসহ মোট এক হাজার ৪০ জন যাত্রী এসেছে। এসব যাত্রী আনার দায়ে অভিযুক্ত ১০টি এয়ারলাইনস হচ্ছে এমিরেটস, সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনস, সালাম এয়ার, কুয়েত এয়ারওয়েজ, এয়ারএশিয়া, এয়ার অ্যারাবিয়া, গালফ এয়ার, মালদিভিয়ান এয়ারলাইনস, টার্কিশ এয়ারলাইনস ও সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস। এরই মধ্যে এয়ারলাইনসগুলোকে সতর্ক করেছে বেবিচক। এর মধ্যে কয়েকটিকে জরিমানাও করা হয়েছে।

গত রবিবার নিয়ন্ত্রক সংস্থার জারি করা নতুন এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সনদ ছাড়া যাত্রী আনলে এয়ারলাইনসের অনুমতিই বাতিল করা হবে। প্রথমবার নিয়ম ভাঙলে একটি ফ্লাইটের, দ্বিতীয়বারের ক্ষেত্রে শাস্তি তিনটি ফ্লাইট, তৃতীয়বারের জন্য এক সপ্তাহ এবং চতুর্থবারের জন্য চার সপ্তাহের জন্য ফ্লাইট স্থগিত করা হবে। কিন্তু এই নির্দেশনার পর গত ২৪ ঘণ্টায় ইতালি, জেদ্দা ও ভারত থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, এমিরেটস ও সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে সাতজন যাত্রী এসেছে করোনা সনদ ছাড়া। এদের মধ্যে বিমানে তিনজন ভারতীয় নাগরিককে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাকিদের কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে। এর দুই দিন আগে করোনা আক্রান্ত যাত্রী আনায় মালয়েশিয়ার বেসরকারি এয়ারলাইনস এয়ারএশিয়া এক লাখ টাকা, মালদিভিয়ান এয়ারলাইনসকে দুই লাখ ৩৬ হাজার টাকা এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

শাহজালাল বিমানবন্দরের সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. হাসান মাহমুদ কাউসার বলেন, গত ১০ দিনে যে পাঁচজন করোনা পজিটিভ যাত্রী এসেছে তার মধ্যে তিনজনই এসেছে বিমানের ফ্লাইটে। গত ৯ ডিসেম্বর দুজন এবং ৮ ডিসেম্বর একজন যাত্রী আসে। এ ছাড়া ১২ ডিসেম্বর একজন যাত্রী এনেছে এয়ারএশিয়া এবং ৭ ডিসেম্বর একজন যাত্রী এনেছে সৌদি এয়ারলাইনস। তিনি জানান, এসব যাত্রী সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া থেকে আসে।

কড়া নির্দেশনার মধ্যেও কেন সনদ ছাড়া যাত্রী আসছে, জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোকাব্বির হোসেন বলেন, ‘আমাদের উড়োজাহাজে আসা যাত্রীদের সবাই সনদ ছাড়া আসেনি। বলা হয়েছে, অভিবাসী শ্রমিকদের যাদের বিএমইটির কার্ড আছে তারা পিসিআর না পেলে অন্য কোনো সনদ নিয়ে আসতে হবে। তারা এমন ঘোষণা দিয়ে বিমানে উঠেছিল, কিন্তু বিমানবন্দরে এসে বিএমইটির কার্ড দেখাতে পারেনি। ৪০০ জনের মধ্যে ছয়জন এভাবে চলে এসেছে। তারা যেসব দেশ থেকে এসেছে সেসব দেশে আমাদের নিজস্ব স্টাফরা বোর্ডিং করে না, ওই দেশে আমাদের প্রতিনিধিরা এই কাজটি করে। আমরা স্টেশন ম্যানেজারদের এ ব্যাপারে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছি।’

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা. শাহরিয়ার সাজ্জাদ বলেন, ‘যাদের করোনা নেগেটিভ সনদ নেই তাদের বোর্ডিং কার্ড ইস্যু করার কথা নয়। যারা সনদবিহীন যাত্রী আনছে, এটা তাদের গাফিলতি। কারণ যা-ই থাকুক, আমরা সবাইকে চেক করছি। বিদেশে গাফিলতি থাকলেও দেশে এসে তারা ধরা পড়ছে। সম্প্রতি করোনা আক্রান্ত যে পাঁচ যাত্রী পাওয়া গেছে, আমরা হাসপাতালে তাদের আইসোলেশনে রেখেছি।’

এদিকে ঢাকার বাইরে অন্য দুটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়েও সনদ ছাড়া যাত্রী আসছে বলে জানা গেছে। ৫ ডিসেম্বরের পর থেকে সিলেটে সরাসরি মোট সাতটি ফ্লাইট এসেছে। এসব ফ্লাইটে এক হাজার ১৭১ জন যাত্রী এসেছে। তাদের মধ্যে একজন যাত্রী নিজের করোনা পরীক্ষার সার্টিফিকেট প্রদর্শন করতে পারেনি। পরে তাকে নগরের খাদিমপাড়া প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন সেন্টারে পাঠানো হয়।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে গত ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট এক লাখ ২৬ হাজার ৬৮৮ জন যাত্রীকে স্ক্রিনিং করা হয়েছে। কভিডমুক্ত সনদের পক্ষে পর্যাপ্ত কাগজপত্র ছিল না এমন ৭৩ জন যাত্রীকে বিমানবন্দর থেকে সরাসরি বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতালে কোয়ারেন্টিনের জন্য পাঠানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ম্যানেজার উইং কমান্ডার ফরহাদ হোসাইন খান বলেন, কভিড নেগেটিভ সনদ ছাড়া বিদেশগামী কোনো যাত্রী যেমন বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে পারছে না, তেমনি বিদেশফেরত যাত্রীদের ক্ষেত্রেও কভিড নেগেটিভ সনদ যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে কঠোরভাবে। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে কভিড নেগেটিভ সনদ যাচাইয়ের পাশাপাশি যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একেক দেশে করোনার ধরন একেক রকম। বাংলাদেশে যে ধরনের করোনাভাইরাস চলছে, তার মধ্যে ইউরোপ কিংবা আমেরিকার যাত্রীর মাধ্যমে আসা ভাইরাসের কারণে নতুন কোনো করোনার ধরন দেশে ঢুকছে কি না তা নিয়েও অনেকের মধ্যে সংশয় রয়েছে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের মাধ্যমে নিজ দেশে করোনাভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি আছে বলেই সারা বিশ্বে এ বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, যাতে কেউ নেগেটিভ সার্টিফিকেট ছাড়া দেশে ঢুকতে না পারে। কিন্তু আমরা নানাভাবে ব্যবস্থা নিয়েও সেটা পুরোপুরি বন্ধ করতে পারছি না। এতে ঝুঁকি যেমন বাড়ছে তেমনি আমাদের নির্দেশনা পালন না করার খারাপ নজির তৈরি হচ্ছে। যেকোনোভাবেই হোক কেউ যেন কোনো দেশ থেকে নেগেটিভ সনদ ছাড়া কিংবা পজিটিভ সনদসহ দেশে ঢুকতে না পারে এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ কঠোর ব্যবস্থা দরকার।’

যাত্রীদের মাধ্যমে করোনার নতুন কোনো ধরন দেশে ঢুকছে কি না, এ বিষয়ে ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘কেউ কেউ এমন ধারণা করলেও আমরা এখন পর্যন্ত এমন কোনো নজির পাইনি। অন্য দেশেও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।’

আরো সংবাদ