স্বাধীনদেশ টেলিভিশন

করোনা কেড়ে নিল রাজনীতির ফেরিওয়ালা এম এ গণির প্রাণ

দেশ-দেশান্তরে প্রায় ৬০ বছর ধরে শুদ্ধ রাজনীতির ফেরি করে আসা বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ এম এ গণি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

আজ বুধবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের চেলসি অ্যান্ড ওয়েস্টমিনিস্টার (কোভিড-১৯) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮১ বছর।

চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালের প্রধান উদ্যোক্তা ও সিইও ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া নিশ্চিত করেছেন।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পদে থাকা এম এ গণির জন্ম চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জ এলাকায় এক জমিদার পরিবারে। এম এ গণির বাবা কোলকাতায় সুলতানিয়া পারফিউমারি ওয়ার্ক্স এর মালিক ছিলেন। সেই সুবাদে কোলকাতায় কেটেছে তার শৈশব। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। ভর্তি হন চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুলে। কিন্তু সেখানে বেশিদিন পড়া হয়নি তার। যে ক্রিকেট মানুষের ভাগ্য বদলে দেয় সেই ক্রিকেটই হয়ে উঠে তার ভাগ্য বিড়ন্বনার কারণ। ছোটকাল থেকেই দারুণ ক্রিকেট খেলতেন। ছিলেন ফাস্টবোলার। পড়াশোনার চেয়ে ক্রিকেটে মনোযোগী হতে গিয়ে মাঝপথেই স্কুল ছাড়তে হয় তাকে।

নানা পথ মাড়িয়ে অবশেষে উচ্চ মাধ্যমিকের যাত্রী হয়ে উঠলেন নটরডেম-এর তরীতে। কিন্তু সেই নটরডেম কলেজেও বেশিদিন থাকা হয়নি তার। ওই যে ক্রিকেট-বিড়ন্বনা। এখানেও চূড়ান্ত বাধা হয়ে দাঁড়ায় ‘ক্রিকেট’। একবার প্রচ- বেগে বল ছুটে যায় আঙিনা থেকে কলেজের জানালায়। ব্যস, তাতেই চুর্ণবিচুর্ণ সব। পরদিন ক্রিকেট-পাগল গণির হাতে ধরিয়ে দেয়া হলো কলেজ ত্যাগের চূড়ান্ত নোটিশ! স্কুল-কলেজ থেকে বিতাড়িত সেই মেধাবী ছাত্রটিই পরবর্তীতে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ-ি মাড়িয়েছেন। উন্নত শিক্ষাগ্রহণ শেষে সমাজ পরিবর্তনের নেশায় বুঁদ হয়ে ফিরে আসেন নিজ শহরে।

এর পরের গল্পটা কেবল এগিয়ে যাবার। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে প্রচারণায় চট্টগ্রাম আসেন বঙ্গবন্ধু। আসেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী প্রমুখ। এসময় দুই তরুণের বলিষ্ঠতা নজড় কাড়ে বঙ্গবন্ধুর। আতাউর রহমান খান কায়সার (আওয়ামী লীগের প্রয়াত প্রেসিডিয়াম মেম্বার) ছাড়া অন্য তরুণটি হলেন আজকের এম এ গণি। বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে এই তরুণ হয়ে উঠেন ক্রমশ দুর্নিবার, দুর্বিনীত। ১৯৬৩ সালে বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে গড়েন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের প্রথম কমিটি। সেই কমিটির প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম এ গণি। জানে আলম দোভাষ সভাপতি ও জহুর আহমদ চৌধুরী (পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী) সাধারণ সম্পাদক। সেই কমিটিতে যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে ঠাঁই পেয়েছিলেন আতাউর রহমান খান কায়সারও।

দলের গুরুত্বপূর্ণ এই পদ তাকে আরও বেশি শাণিত করে দলকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে। ’৬৫ সালে আইয়ুব সরকার মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচনের আয়োজন করেন। তাতে আওয়ামী লীগ অংশ না নিলেও বঙ্গবন্ধুর অনুমতি নিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন গণি। সেসময় চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র আন্দরকিল্লা থেকে মুসলিম লীগের শক্তিশালী প্রার্থীকে পরাজিত করে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। অপরদিকে চন্দনপুরা থেকে নির্বাচন করে হেরে যান আতাউর রহমান খান কায়সার। পর পরই এম এ গণি শত বছরের প্রাচীন কো-অপারেটিভ ব্যাংকের পরিচালক নির্বাচিত হন বিপুল ভোট পেয়ে।

১৯৬৭ সালে বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রামে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তুঙ্গস্পর্শী আন্দোলন। সেই আন্দোলনের প্রথম সারির মানুষ এম এ গণি। আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালের সামনে আইয়ুববিরোধী মিছিলে নেতৃত্বরত গণিকে টার্গেট করে আইয়ুব সরকারের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনী। পিটিয়ে, পিষিয়ে মুমূর্ষূ করে তোলা হয় তাকে। এসময় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বাবার কর্মস্থলের সুবাদে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, বর্তমান সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী। বলা বাহুল্য, এই সাজেদা চৌধুরীই মুমূর্ষ গণিকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেন।

১৯৬৬ সালের দিকে চট্টগ্রাম সফরে আসেন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান। সার্কিট হাউসে জরুরি বৈঠক। সেই অনুষ্ঠানে অন্যদের মতো আমন্ত্রিত হয়ে আসেন ওয়ার্ড কমিশনার এম এ গণি। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বক্তৃতা শুরু করেন এভাবে ‘ইউ পিপল টু মাচ পলিটিক্যালি মোটিভিটেড অ্যান্ড বিহেভ লাইক অ্যা ডগস ফর দ্যা পিস অব বোন’। তুমুল করতালি সার্কিট হাউজের পুরো হলরুমে। আইয়ুব খান ভেবেছিলেন এর মর্মার্থ কেউ বুঝতে পারবেন না। ততক্ষণে অন্যরকম এক উন্মাদনা তৈরি হয় এম এ গণির ভেতরে। ক্ষোভে, অপমানে রীতিমতো অগ্নিশর্মা তিনি। আর দেরি নয়, সাড়ে আট টাকা দামের জুতা ছুঁড়ে মারলেন আইয়ুব খানের দিকে। জুতা খেয়ে অধস্তনদের হতবিহ্বল আইয়ুব খানের তাৎক্ষণিক নির্দেশ ‘শুট হিম’। এ অবস্থায় এমন লাফ দিলেন গণি, একেবারে গিয়ে পড়লেন নিজ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে।

স্টিয়ারিং ধরে সোজা টার্ন নিলেন জালালাবাদ পাহাড়ের দিকে। এক মহিলার ঘরে তিনদিন আত্মগোপনে থাকার পর মায়ের অসুস্থতার খবর শোনে বাড়িতে ছুটে আসেন, আর তখনই ওঁৎ পেতে থাকা পুলিশ বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। উপরের নির্দেশ ছিলো গণিকে পিটিয়ে আধমরা করার। কিন্তু কোতোয়ালী থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুস সাত্তারের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক এম এ গণির। সেই সম্পর্কের সুঁতোয় গাঁথলেন, বাঁচলেন। ওসি সাহেবের স্ত্রী নিজেই গণির পিঠে এমনভাবে তেল আর কালি মেশালেন তাতে মনে হবে নির্যাতনের অনেক ধকল বইয়ে গেছে মায়াবি এই পিঠে। পরদিন থানা হাজতে মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী এই অবস্থা দেখে ভড়কে যান, বলেন এমনভাবে মারার কী প্রয়োজন ছিল ছেলেটারে!

বলা বাহুল্য, এই সময় চট্টগ্রাম সুইপার এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন এম এ গণি। তার গ্রেফতারের প্রতিবাদে সুইপার কলোনির হাজার হাজার মানুষ ঘিরে ফেলে কোতোয়ালী থানা। বালতি বালতি মল ছিটিয়ে অবরূদ্ধ করে রাখে থানা কম্পাউন্ড ও এর আশপাশ।

নির্যাতন, কারাবাস একের পর এক হুলিয়ার মুখে একসময় দেশত্যাগে বাধ্য হন গণি। ১৯৬৯ সালের কোনো এক বিকেলে লন্ডনের উদ্দেশ্যে মিলিয়ে যান আকাশে। আর এই ধরায় রেখে যান কত স্মৃতি, কত দেশপ্রেম, দ্রোহ আর সংগ্রামের বীরত্বপূর্ণ অধ্যায়। সেখানে গিয়েও বসে থাকেননি তিনি। যার ধমনীতে দেশমুক্তি, বাংলা-বাঙালির দুঃখগাথা বদলের অন্যরকম নেশা- তিনি বসে থাকেনইবা কী করে! আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার পর লন্ডন গিয়ে এম এ গণিকেই সবার আগে খুঁজে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এসময় বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও তার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া। তুখোর এই সংগঠকের বিচক্ষণ, বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি সেই প্রথম দেখাতেই নজর কাড়ে শেখ হাসিনার।

আরো সংবাদ