স্বাধীনদেশ টেলিভিশন

করোনাকালে দেশে আত্মহত্যা বেড়েছে সাড়ে ৪ হাজার: জরিপ

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে দেশে আত্মহত্যা বেড়েছে বলে একটি জরিপ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

গত বছরের ৮ মার্চ থেকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে করা এই জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ সময়ে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন।

করোনা শুরুর আগের বছর ২০১৯ সালে ১০ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে বলে জানিয়েছিল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। ওই দিন থেকেই জরিপ শুরু করে আঁচল ফাউন্ডেশন নামের বেসরকারি সংস্থা।

জরিপের অংশ হিসেবে তারা দেশের দৈনিক সংবাদপত্র, হাসপাতাল ও পুলিশের কাছ থেকে তথ্য নিয়েছে।

সংস্থাটি ৩২২টি আত্মহত্যার কেস স্টাডি বিশ্লেষণ করে আত্মহত্যাকারীদের বয়স, জেন্ডার ও আত্মহত্যার কারণ তুলে ধরেছে।

শনিবার ভার্চুয়াল এক অনুষ্ঠানে আঁচল ফাউন্ডেশন তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

জরিপে গত বছরের মার্চ থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত সময়কে এক বছর ধরা হয়েছে। সে হিসাবে ২০১৯ সালের তুলনায় এক বছরে আত্মহত্যা বেড়েছে ৪ হাজার ৪৩৬ জন। আত্মহত্যা বাড়ার এ হার ৪০ শতাংশ।

জরিপে উঠে এসেছে, দেশে আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ পুরুষ ও ৪৩ শতাংশ নারী। ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে। যেসব কারণে আত্মহত্যা করেছে, তার মধ্যে আর্থিক, পড়াশোনা, পারিবারিক সম্পর্কজনিত জটিলতা, হতাশা ও বিষণ্নতা অন্যতম।

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তানসেন রোজ বলেন, ‘তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে আমি একজন তরুণ হিসেবে শঙ্কিত। যে হারে মানসিক সমস্যা বাড়ছে সে হারে বাড়ছে না সচেতনতা। যে কারো আত্মহত্যা করার পিছনে আমাদের পরিবার, সমাজ ও দেশেরও দায় রয়েছে। একটা মানুষ কেন আত্মহত্যা করে তা নিয়ে নির্মোহ বিশ্লেষণ করা দরকার।’

তিনি বলেন, ‘আত্মহত্যা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার আগেই দেশের নীতিনির্ধারকসহ সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা যারা তরুণ আছি, সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখার দায়িত্ব তাদেরই। আমাদের একটা কথা মাথায় রাখতে হবে আত্মহত্যার কারণগুলো আমাদের কাছে যত তুচ্ছই হোক না কেন, আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির কাছে তা অনেক বড় একটি ব্যাপার।

‘তাই মানসিক স্বাস্থ্যকেও গুরুত্ব দিয়ে প্রত্যেকটা নাগরিকের বেঁচে থাকার পরিবেশ নিশ্চিত রাষ্ট্রসহ প্রত্যেকেরই দায়িত্ব ও কর্তব্য।’

রোজ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে আমাদের জোর দাবি, প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিশ্চিত করা হয়। পাশাপাশি পরিবার কীভাবে আত্মহত্যা কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়ে রূপরেখা দাঁড় করানো দরকার। সবাইকে সচেতন না করতে পারলে ফলাফল অধরাই থেকে যাবে।’

চিকিৎসকরা বলছেন, করোনাকালে জেন্ডার, সামাজিক শ্রেণির ভিন্নতায় আলাদা আলাদা রকমের মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। কারও চাকরি নেই, কেউ স্বামী-সন্তানকে নিয়ে চিন্তিত, কেউ ব্যবসায়িক কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কেউ আবার নিজের শরীর, স্বাস্থ্য নিয়ে এতটাই চিন্তিত হয়ে পড়ছেন যে, তাদের মধ্যে মানসিক অবসাদ দেখা দিচ্ছে। আর সেই অবসাদই ঠেলে দিচ্ছে আত্মহত্যার দিকে।

এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘করোনার কারণে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। অনেকের আয় কমে আসছে। অনেকে নিজের ব্যবসা হারিয়ে হতাশায় ভুগছেন। এ কারণে বিষণ্নতা ও মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। তবে রোগী বাড়লেও চিকিৎসার বাইরে থাকছেন অনেকে।

‘মানসিক সমস্যা দেখা দিলে বিষয়টি রোগী প্রথমে বন্ধু বা পরিবারের লোকের সঙ্গে শেয়ার করে। অনেকেই সচেতন না হওয়ার কারণে তার অস্বাভাবিক আচরণকে গুরুত্ব না দিয়ে তার সঙ্গেই দুর্ব্যবহার করেন। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই হতাশা, উদ্বেগ, বিষণ্নতা থেকে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মোহিত কামাল বলেন, ‘আত্মহত্যা ও আত্মহত্যার প্রবণতা একটি অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বিষণ্নতার কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। দৈনন্দিন জীবনের জটিলতা ও প্রযুক্তির প্রতি মানুষের আসক্তি বেড়েছে। ফলে প্রায় দুই দশকে আত্মহত্যার চিত্রের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি (কমেনি)।

‘অনেক সময় সামাজিক কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, যা মোটেও উচিত নয়। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।’

আত্মহত্যা রোধে আঁচলের সুপারিশ

প্রতিবেদনে আত্মহত্যা রোধে আঁচল ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।

এর মধ্যে রয়েছে মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো; আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে সাবধানে রাখা, হাতের কাছে ছুরি, কাঁচি, ওষুধ না রাখা; আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে একা না রাখা; আত্মহত্যার সতর্ক সংকেত সম্পর্কে জানা; গণমাধ্যমে দায়িত্বশীল প্রতিবেদন লেখা ও প্রকাশ করা, যথাসম্ভব আত্মহত্যার বিস্তারিত বিবরণ ও ধরন বর্ণনা থেকে বিরত থাকা; ক্রাইসিস সেন্টার ও টেলিফোন হটলাইন সারা দেশে চালু করা; আত্মহত্যা রোধে সমাজের সব স্তরের মানুষের এগিয়ে আসা; আত্মহত্যায় ব্যবহৃত জিনিস সহজলভ্য না করা; সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলর নিয়োগ নিশ্চিত করা ও সরকারি উদ্যোগে আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিদের সহযোগিতার ব্যবস্থা করা।

আরো সংবাদ