স্বাধীনদেশ টেলিভিশন

রড-সিমেন্টও সিন্ডিকেটের দখলে

মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম হল বাসস্থান। আবার বাসস্থানসহ নানা স্থাপনা নির্মাণের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল রড-সিমেন্ট। ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৫৬’ অনুযায়ী এ দুটি পণ্য হচ্ছে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য। এবার চট্টগ্রামে এই অত্যাবশ্যকীয় পণ্য রড-সিমেন্টের দাম বৃদ্ধিতে বাসস্থান বা স্থাপনা নির্মাণে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ।

নগরের বিভিন্ন সিমেন্ট বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরেজমিনে দেখা যায়, ৫০ কেজির রয়েল সিমেন্ট প্রতি বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৫২০ টাকা, অথচ মাসখানেক আগে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পূর্বে এ কোম্পানির সিমেন্টের দাম ছিল ৪২০-৪৪০ টাকা। একই ভাবে, কনফিডেন্স সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৫৩০ টাকা প্রতি বস্তা, যা আগে ছিল ৪৪০ টাকা। রুবি সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে প্রতি বস্তা ৫৫০ টাকা, যা আগে বিক্রি হত ৪৫০ টাকা। ক্রিমিয়ার ও সেভেন রিংস সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে প্রতি বস্তা ৫২০ টাকা দরে, এ দুই প্রতিষ্ঠানের সিমেন্ট মাসখানেক আগেও বিক্রি হয়েছে ৪৩০-৪৫০ টাকা প্রতি বস্তা। এছাড়া ফ্রেশ সিমেন্ট বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে বস্তা প্রতি ৫১০ টাকা, যা আগে ছিল প্রতি বস্তা ৪২০ টাকা।

গত ৬ আগস্ট থেকে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিকে ঢাল বানিয়ে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট মাসখানেকের মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সিমেন্টের দাম বস্তা প্রতি বাড়িয়েছে প্রায় ১০০ টাকা। এই এক মাসের মধ্যে বিভিন্ন কোম্পানির সিমেন্টের দাম প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। ফলে পণ্যটির বাড়তি দামের কারণে বাড়ি-ঘর নির্মাণ ব্যয় নিয়ে বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ।

কাতার প্রবাসী মাসুদুল করিম দেশে এসেছেন মাস চারেক আগে। নগরের পশ্চিম মাদারবাড়ি এলাকার এই বাসিন্দা বাড়ি নির্মাণের জন্য সিমেন্ট কিনতে এসেছেন চৌমুহনী এলাকায়।  আট বছর ধরে প্রবাসে কষ্ট করে টাকা আয় করেছি। এর মধ্যে অজস্রবার দেশে টাকা পাঠিয়েছি, ফলে এত বছর সরকারকে রেমিট্যান্সে সাপোর্ট দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখেছি। চার মাস আগে দেশে এসে পরিকল্পনা করেছি আগের সেমি পাকা(আধা পাকা) বাড়িটি এবার নতুনভাবে সম্পূর্ণ পাকা করার। কিন্তু বাড়ি নির্মাণের উপাদান রড-সিমেন্ট কিনতে এসে চিন্তায় পড়ে গেলাম। সব কিছুর দাম অনেক বাড়তি। দেশে আসার আগে রড-সিমেন্ট বাবদ যে বাজেট ভেবেছিলাম, দেশে এসে দেখছি তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা লাগছে।

এদিকে গত আগস্ট মাসের শুরুতে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর থেকে কয়েক ধাপে বেড়েছে সিমেন্টের দাম। জ্বালানি তেলের এই মূল্য বৃদ্ধিকে ঢাল বানিয়ে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট গত এক মাসে বস্তা প্রতি সিমেন্টের দাম প্রায় ২৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। অথচ জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির সাথে সিমেন্টের এই দাম বৃদ্ধির মধ্যে কোন ধরণের সামঞ্জস্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির আগে বস্তা প্রতি ১০ টাকা করে ২০০ বস্তা সিমেন্ট বহনকারী একটি ট্রাকের ভাড়া ছিল ২ হাজার টাকা। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর বস্তা প্রতি ৩ টাকা বেড়ে সে ভাড়া পড়ছে ২ হাজার ৬০০ টাকা। ফলে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর সীতাকুন্ড এলাকায় অবস্থিত সিমেন্ট ফ্যাক্টরীগুলো থেকে নগরে ২০০ বস্তা সিমেন্ট ধারণ ক্ষমতার গাড়ি প্রতি ভাড়া বেড়েছে ৬০০ টাকা, অথচ অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট গাড়ি প্রতি সিমেন্টের দাম বাড়িয়েছে ২০ হাজার টাকা।

সিমেন্ট বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ‘এরশাদ এন্টারপ্রাইজ’ এর মালিক জানেন, বর্তমানে সিমেন্টের দাম বৃদ্ধিতে আগের তুলনায় বিক্রি কিছুটা কমেছে। আগে এক-দুই দিন পর মালের(সিমেন্ট) গাড়ি আসত, এখন বিক্রি কমে যাওয়ার কারণে তা অনেক সময় সপ্তাহে একবার আনতে পারি। প্রায় সব কোম্পানির সিমেন্টের দাম বেড়েছে। তাদের থেকে বাড়তি দামে কিনলে, আমাদেরকেও তো বাড়তি দামে বিক্রি করতে হয়। আজকে ফ্যাক্টরি থেকে রয়েল সিমেন্ট অর্ডার করেছি প্রতি বস্তা ৪৯৫ টাকা দরে, কনফিডেন্স সিমেন্ট প্রতি বস্তা ৫১৫ দরে ফ্যাক্টরি থেকে অর্ডার করেছি। এর সাথে লোডিং-আনলোডিং চার্জ বস্তা প্রতি ৮ টাকা যোগ হবে। এভাবে ফ্যাক্টরী থেকে বাড়তি দামে কিনে অন্যান্য খরচ যোগ করলে আমাদেরকেও ক্রেতাদের কাছে বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

এদিকে বাসস্থান বা স্থাপনা নির্মাণের আরেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে রড। বর্তমানে চট্টগ্রামে এই অত্যাবশ্যকীয় পণ্যটির দাম বৃদ্ধির সাথে কমেছে সরবরাহও। তাই রডের দাম বৃদ্ধিতে সাধারণ ক্রেতাদের সাথে শঙ্খায় রয়েছে বিক্রেতারাও। দাম বাড়ার পর থেকে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দোকানে রডের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। আগে রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নগরের রড বিক্রয়কারী দোকানগুলোতে নিয়মিত ২-৫ টন রড সরবরাহ করত, কিন্তু বর্তমানে দাম বৃদ্ধির পর থেকে তা ২০০ থেকে ৩০০ কেজিতে এসে ঠেকেছে। ফলে বিক্রেতারা সাধারণ ক্রেতাদের কাছে চাহিদা মত রড বিক্রি করতে পারছে না।

নগরের রড বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৬০ গ্রেডের রড প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০-৯৫ টাকা দরে। অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের ৪০ গ্রেডের রড বিক্রি হচ্ছে ৮৬-৯০ টাকা। যা কিছুদিন আগেও কেজি প্রতি ৮-১০ টাকা কমে বিক্রি হয়েছিল।

এ বিষয়ে নগরের রড বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স তারেক এন্টারপ্রাইজ’ এর মালিক মো. তারেক সাংবাদিকদের বলেন, চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী থেকে কুমিরা পর্যন্ত এলাকাজুড়ে বিএসআরএম, আবুল খায়ের ও জিপিএস ইস্পাতের মত দেশের বড় রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ফ্যাক্টরি রয়েছে। আমরা দোকানে বিক্রির জন্য এখান থেকে রড আনি। রডের দাম বৃদ্ধির পর থেকে কোম্পানিগুলো আমাদের কাছে রডের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। আগে আমি নিয়মিত ২-৩ টন রড আনতাম দোকানে বিক্রির জন্য, এখন এ পরিমাণ রড দেয় না কোম্পানিগুলো। অনেক চেষ্টা করে কখনও ৩০০ কেজি আবার কখনও বা ৪/৫ শ কেজি আনতে পারি। এ কারণে অনেকে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের জন্য অগ্রিম রড অর্ডার করে রাখলেও সময় মত তাদেরকে রড বুঝিয়ে দিতে পারিনা, ফলে ক্রেতাদেরকে হারাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, আমাদেরকে কেন চাহিদা মত রড দিতে পারছে না তা জানতে চাইলে কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে, লোডশেডিংয়ের কারণে রডের উৎপাদন কমে গেছে। এছাড়াও প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও রড উৎপাদনে ব্যবহৃত স্ক্রাব সংকটের কারণে সরবরাহ কমেছে বলে জানায় কোম্পানিগুলো।

আরো সংবাদ