স্বাধীনদেশ টেলিভিশন

দেশে করোনার মিউটেশন হয়েছে ৪১৬০ বার

বাংলাদেশ থেকে ৩২৪টি করোনাভাইরাসের (সার্স কোভ-২) জিনোম সিকোয়েন্সিং করে এর চার হাজার ১৬০ বার মিউটেশন হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সেন্ট্রাল ফর মেডিক্যাল বায়ো-টেকনোলজি বিভাগ। গত ৩০ মার্চ থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে এই নমুনা সংগ্রহ করা হয়।

বুধবার (১৪ অক্টোবর) স্বাস্থ্য অধিদফতরের সেন্ট্রাল ফর মেডিক্যাল বায়ো-টেকনোলজি বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মারুফুর রহমান অপু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে জমা দেওয়া ৩২৪টি করোনাভাইরাসের জিনোম বিশ্লেষণ করে এর মিউটেশনগুলোর সম্ভাব্য প্রভাব সংক্রান্ত এবং এর ব্যাখ্যা সম্বলিত আমাদের গবেষণাপত্র বায়ো-আর্কাইভে আপলোড করেছি। এটি আন্তর্জাতিক জার্নালেও প্রকাশের জন্য জমা দেওয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘স্টাডিতে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে যে স্ট্রেইনগুলো বেশি ঘুরছে তার সংক্রমণ প্রবণতা বেশি। কিন্তু তার রোগের তীব্রতা কম এবং এ দিয়ে সম্ভবত ব্যাখ্যা করা সম্ভব বাংলাদেশে কেন মৃত্যুহার কম।’ তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়, আরও অনেক কারণ থাকতে পারেও বলেও মন্তব্য তার।

আর এ বিষয়ে আরেকটি গবেষণাও হচ্ছে যেটা হয়তো চলতি মাস অথবা আগামী মাসের শুরুতে প্রকাশ করা হবে। 

গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে জানাতে গিয়ে ডা. মারুফুর রহমান অপু বলেন, ‘সবগুলো নমুনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে মিউটেশনগুলো হয়েছে সেগুলো হলো– 241C>T (৯৬%), 3037C>T (৯৮%), 14408C>T (৯৮%) এবং 23403A>G (৯৭%)।  এই মিউটেশনগুলো প্রায় একই সঙ্গে ঘটেছে এবং শেষের দুটি আমাইনো এসিড চেঞ্জিং মিউটেশন (RdRp জিনে P323L এবং স্পাইক প্রোটিনে D614G)।’

তিনি বলেন, ‘P323L মিউটেশন হলে ভাইরাসটিতে মিউটেশনের হার আরও বেড়ে যায়, আর D614G মিউটেশনটি সারা বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত। মূলত ইউরোপে ডমিনেন্ট হওয়া এই মিউটেশনটি বর্তমানে সারা বিশ্বেই মূল ধরন (প্রায় ৭০% ক্ষেত্রেই এই মিউটেশনধারী ভাইরাসটি ছড়াচ্ছে)। বাংলাদেশে ৯৭% নমুনাতেই এই মিউটেশনটি আছে। আর এর ফলে ভাইরাসটির বংশবৃদ্ধির সক্ষমতা বেড়ে যায়। তবে কিছু গবেষণা অনুসারে জানা যায়, বংশবৃদ্ধির সক্ষমতা বাড়লে বিপরীতক্রমে রোগের তীব্রতাও কমে। D614G-এর কারণে মৃত্যু হার বাড়ে না কমে এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনও প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।’

গবেষণার আরও ফলাফল সম্পর্কে জানিয়ে ডা. মারুফুর রহমান বলেন, ‘১৩২৪টি জিনোম স্যাম্পলে মোট ৪১৬০টি মিউটেশন ঘটেছে। যার মাঝে অ্যামাইনো এসিড পরিবর্তনকারী মিউটেশন ২২৫৩টি, মুছে যাওয়া/ডিলিশন ৩৮টি এবং সংযোজন/ইনসারশন ১০টি।

‘আবার, অধিকাংশ মিউটেশনই C>T অর্থাৎ নিউক্লিওটাইড C থেকে পরিবর্তিত হয়েছে T-তে (৪১%)। এটি সম্ভবত সিলেক্টিভ মিউটেশন প্রেশারের কারণে। যেখানে ভাইরাসটি তার জিনোম থেকে CpG অংশগুলো সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে, যেন এই অংশগুলোকে টার্গেট করে ভাইরাসটিকে মেরে ফেলতে যেসব ইমিউন রিঅ্যাকশন হতো সেগুলো কম হয়। এর ফলে সম্ভবত ভাইরাসটির বংশবৃদ্ধির হার বেড়ে যায় তবে রোগ লক্ষণের তীব্রতাও কমে যায়।

‘গবেষণার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, অ্যান্টিবডির মূল টার্গেট স্পাইক প্রোটিনের রিসেপ্টর বাইন্ডিং অংশ। যেখানে বাংলাদেশের কোনও নমুনাতেই কোনও মিউটেশন ঘটেনি। তাই আশা করা যাচ্ছে, ভ্যাকসিন যে দেশ থেকেই আসুক তা এদেশে কাজ করবে, যদি আসলেই কার্যকরী ভ্যাকসিন পাওয়া যায়।

‘এছাড়াও ORF7a এবং ORF8 জিনের বড় অংশ মুছে গেছে এমন পাঁচটি নমুনা পাওয়া গেছে। ORF7a প্রোটিন না থাকলে সম্ভবত ভাইরাসটি দ্বারা সৃষ্ট রোগের তীব্রতা কম হয় এবং ORF8 না থাকলে ভাইরাসটির আমাদের ইমিউন সিস্টেম দ্বারা চিহ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।’

বাংলাদেশে সম্ভবত কয়েকবার কয়েকটি ভিন্ন জায়গা থেকে ভাইরাসটি এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসটি মূলত ইউরোপিয়ান ভ্যারিয়েন্টগুলোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যা সরাসরি ইউরোপিয়ান দেশ বা মধ্য পূর্ব হয়ে ইউরোপিয়ান দেশের স্যাম্পলগুলোর সঙ্গে ক্লাস্টার তৈরি করেছে।

‘আমাদের নমুনাগুলোর প্রায় ৮৬%-ই 20B ক্লেডভুক্ত যা ইউরোপে (ইউকে, বেলজিয়াম সুইডেন) ডমিনেন্ট ছিল। আশেপাশের দেশগুলোতে চিত্রটি এমন নয় (ইউরোপিয়ান ভ্যারিয়েন্ট-এর আধিক্য এত বেশি না)। 19B ক্লেড যেটি মূলত চায়নাতে ডমিনেন্ট ছিল, সেটি আমাদের শুধু চট্টগ্রামের পাঁচটি নমুনায় পাওয়া গেছে। সম্ভবত চট্টগ্রামে চায়না থেকে ভাইরাসটি সরাসরি বা অন্য দেশ হয়ে কোনোভাবে এসেছিল।’

ডা. মারুফুর রহমান অপু জানান, তাদের এই গবেষণাপত্র এখনও পিয়ার রিভিউড হয়নি, তাই এটিকে চূড়ান্ত বিবেচনা করা উচিত হবে না। আর বিশেষজ্ঞদের মতামত পাওয়া সাপেক্ষে তারা এতে আরও কাজ করবেন।

এ গবেষণা কাজে ডা. মারুফুর রহমান ছাড়া আরও যুক্ত ছিলেন– আইসিডিডিআর-বির গবেষক ডা. শারমিন বিনতে কাদের এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ শাখার ডা. এস এম শাহরিয়ার রিজভী।

আরো সংবাদ