স্বাধীনদেশ টেলিভিশন

করোনা ভ্যাকসিন কি নিরাপদ?

করোনাভাইরাসের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রেকর্ড সময়ে বেশ কিছু ভ্যাকসিন উদ্ভাবিত হয়েছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োগ শুরু হয়েছে। মডার্নার টিকা ও প্রয়োগ করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। প্রশ্ন হচ্ছে এসব টিকা কি নিরাপদ? তাছাড়া কতদূর কাজ দেবে ওগুলো?

টিকা বের করতে সাধারণত কয়েক দশক না হলেও বেশ কয়েক বছর লেগে যায়। কিন্তু ফাইজার ও মডার্না মাত্র ১০ মাসের মধ্যে টিকা বের করে ফেলেছে। বের করেছে ব্রিটেনের অস্ট্রাজেনেকাও। অস্ট্রাজেনেকা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় ভারতসহ পাঁচটি দেশে টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের চূড়ান্ত পর্ব সম্পন্ন করেছে। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে এই টিকার সাফল্যের হার অনেক বেশি। এদিকে রাশিয়ার গামালেয়া ন্যাশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি এ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজির উদ্ভাবিত স্পুটনিক-৫ ইতোমধ্যে স্বদেশে ব্যবহারের ছাড়পত্র পেয়েছে এবং তা প্রয়োগ করা হচ্ছে। চীনেও দুটি ভ্যাকসিন-সিনোফার্ম ও সিনোভাক অনুমোদন লাভ করেছে। এগুলোর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ বেশ আগেই শুরু হয়েছিল। ওদিকে ভারতের দুটি প্রতিষ্ঠান ভারত বায়োটেক ও জাইডাস ক্যাডিলার উদ্ভাবিত টিকার ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চলছে। আরও পাঁচটি ভারতীয় কোম্পানি জেনোভা ফার্মাসিউটিক্যালস, অরবিন্দ ফার্মা, রিলায়েন্স লাইফ সায়েন্সেস, মিনভাক্স ও সিরাম ইনস্টিটিউট কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছে এবং সেগুলো প্রাক-ক্লিনিকাল পরীক্ষার স্তরে আছে।

এখানেই শেষ নয়। বিশ্বজুড়ে আরও অনেক ভ্যাকসিন উদ্ভাবিত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী দেড়শর বেশি করোনা ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের পথে আছে। তার মধ্যে প্রায় ৪৪টির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে এবং ১১টি পরীক্ষার শেষ পর্যায়ে আছে। নিঃসন্দেহে উদ্দীপ্ত হওয়ার মতো খবর। তবে সেই উদ্দীপনাকে সতর্কতা ও সংশয় নিয়ে সংযত রাখতে হবে। ভ্যাকসিনগুলো যেরূপ অবিশ্বাস্য গতিতে উদ্ভাবিত হচ্ছে তা অসাধারণ ঘটনা। কিছু কিছু ভ্যাকসিনের উচ্চমাত্রায় কার্যকারিতার খবরগুলোও দারুণ। তথাপি অনেক প্রশ্নই অনুত্তর রয়ে গেছে। বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা, সুরক্ষা পাওয়ার মেয়াদ, বিতরণ কার্যক্রম ইত্যাদি। এমন প্রশ্নও উঠছে, ওইসব ভ্যাকসিন কতটা নিরাপদ এবং কতখানি কার্যকর হবে।

ভ্যাকসিন নিয়ে বিশেষ করে সেগুলো নিরাপদ কতটা তা নিয়ে সংশয়ের উদ্রেক হয়েছে এই কারণে যে এগুলো অকল্পনীয় দ্রুতগতিতে উদ্ভাবিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা লক্ষ্য করেছেন যে সারা বিশ্বের ওষুধ কোম্পানিগুলো গত ২৫ বছরে সত্যিকারের নতুন ৭টি টিকা বের করেছে। বৃহৎ ওষুধ কোম্পানি মার্ক-এর মাম্পসের টিকা বের করতে ৪ বছরের গবেষণা ও উন্নয়নের প্রয়োজন হয়েছে এবং এবোলার টিকা অনুমোদন পেতে সাড়ে পাঁচ বছর লেগেছে। গত জুলাই মাসে করোনা টিকা উদ্ভাবনের প্রয়াসে প্রবল গতি সঞ্চারিত হলে মার্কের সিইও কেনিথ ফ্রেজিয়ার বলেছিলেন, ‘আমার কাছে সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপারটা হলো এই যে মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যাওয়ার জন্য এত ব্যাকুল এত মরিয়া হয়ে উঠেছে যে তারা আমাদের টিকা বের করার কাজটা দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে করার জন্য ঠেলে দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত একটা টিকা কয়েক শ’ কোটি মানুষের ওপর প্রয়োগ করলে সে টিকা কতটা কাজ করছে তা ভালভাবে জানতে পারা যাবে।’ নির্মম পরিহাসের ব্যাপার হলো, ফাইজারের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান বিজ্ঞানী ড. মাইকেল ইয়াডন সম্প্রতি এক নিবন্ধে করোনা মহামারীর অবসান ঘটাতে টিকার প্রয়োজনীয়তা খণ্ডন করে বলেছেন মহামারী যথার্থ অর্থে শেষ হয়ে গেছে। কেননা যুক্তরাজ্যের জনগোষ্ঠী ইতোমধ্যে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের সময়টা কয়েক বছরের পরিবর্তে কয়েক মাসে কমিয়ে আনার পিছনে বেশ কিছু কারণ আছে। তার মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য কারণটি হলো ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে সহযোতিামূলক বৈশ্বিক উদ্যোগ এবং দ্রুত ফল পেতে গবেষণার জন্য বরাদ্দ তহবিল। হু এ ব্যাপারে ৫শ’ কোটি ডলার সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অপারেশন ওয়ার্প স্পিডের অধীনে ২০২১ সালের জানুয়ারির মধ্যে আমেরিকানদের ২০ কোটি ডোজ টিকা যোগানোর জন্য ৯৫০ কোটি ডলার নির্দিষ্ট করে রাখেন। ইউরোপীয় কমিশনের উদ্যোগের টার্গেট হলো ৪শ’ কোটি ডলার সংগ্রহ। সেপি দানশীল ব্যক্তিদের দেয়া ২শ’ কোটি ডলার সংগ্রহ করে। সুতরাং কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন অতি দ্রুত উদ্ভাবিত হবার পিছনে প্রধানত বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে সুবিশাল সহযোগিতা, সরকারগুলোর এবং হু, সেপির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা ও অন্যান্য দাতাদের জোর উদ্যোগ কাজ করেছে। তাছাড়া সরকারী সংস্থা ও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গতানুগতিক পথের বাইরে নিয়ে দ্রুত সাড়া দিয়েছে। সবাই যুদ্ধকালীন জরুরী ভিত্তিতে কাজ করেছে এবং লাল ফিতার দৌরাত্ম্য পরিহার করেছে। সবকিছুই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে করা হয়েছে। আগে যাতায়াত ও বৈঠকের পিছনে প্রচুর সময় ব্যয় হতো। এখন বেশিরভাগ আলোচনা ওয়েবসাইটে করা হয়েছে।

ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের কাজটা ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হয়েছে খোদ ভাইরাসটির কাঠামো। ভাইরাসটি বিস্ময়কর গতিতে নিজের প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে এবং অতি দ্রুত মানুষের ইমিউন ব্যবস্থাকে পরাভূত করতে পারে। ভাইরাসটি যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে তা নানাভাবেই বিজ্ঞানীদের জানা ছিল। গবেষকরা এর পূর্ব পুরুষদের সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি হন ২০০২ সালে যখন সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম করোনা ভাইরাস বা সংক্ষেপে সার্স কোভ-এর প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। ওতে আট হাজারেরও বেশি লোক আক্রান্ত হয়েছিল এবং মারা গিয়েছিল ৭৭৪ জন। ভাইরাসটি কিছুদিন চুপচাপ ছিল। এরপর ২০১২ সালে মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম বা সংক্ষেতে মার্স- কোভ নামে পুনরায় আত্মপ্রকাশ করে। এটা করোনাভাইরাসের আরেক আত্মীয়। এতে প্রায় ৩ হাজার লোক আক্রান্ত হয়। মৃত্যুহারও বেশি ছিল। ততদিনে গবেষকরা স্পাইক প্রোটিন নামে করোনাভাইরাসের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বের করে ফেলেন। স্পাইক প্রোটিন মানুষের দেহকোষের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে নিজের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে। এই স্পাইক প্রোটিনকে ব্যাহত করা যায় একটি ভ্যাকসিন দিয়ে যে ভ্যাকসিনের কাজ হবে ঐ প্রোটিনের বিরুদ্ধে এন্টিবডি গড়ে তোলা।

কোভিড-১৯ রোগটি ঘটে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের দ্বারা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে এটি বিজ্ঞানীদের রাডারে প্রথম ধরা পড়ে। ভাইরাসটির আকৃতি ছিল সর্পিল এবং স্পাইক সর্বস্ব যা পেপলোমার নামে পরিচিত। গবেষকরা জানতে পেরেছিলেন ভাইরাসটিকে ঘায়েল করতে হলে এর কোন অংশটিকে টার্গেট করতে হবে। বড় কথা হলো উহানের আদি ভাইরাসের একটা রূপান্তর ঘটা ছাড়া কোভিড-১৯-এর খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। ফ্লূ ভাইরাসের দ্রুত রূপান্তর ঘটে থাকে। কিন্তু কোভিড-১৯-এর ভাইরাসের ক্ষেত্রে ঠিক তেমন ঘটে না। এই ভাইরাস তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। যার কারণে বিশেষজ্ঞদের পক্ষে ভ্যাকসিন দিয়ে ভাইরাসটি মোকাবেলা করার জন্য জিন প্রযুক্তিসহ নানা ধরনের কৌশল কাজে লাগানো সম্ভব হয়েছে। ডিএনএ ও আরএনএ ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করা তুলনামূলক ভাবে সহজ। তবে এগুলো হচ্ছে নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তি এবং এতদিন পর্যন্ত মানবদেহে তা প্রয়োগ করা হয়নি। বলা হয় এমন ভ্যাকসিনের পিছনে সুদৃঢ় বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্ত ও যুক্তি আছে। তবে এসব টিকা দীর্ঘমেয়াদী বিচারে কতটা ভাল, সম্ভবসাধ্য ও সফল তা ব্যাপক পরিসরে মানবদেহে প্রয়োগের পরই কেবল জানতে পারা যাবে।

নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগের ব্যাপারটা ছাড়াও আরও বিষয় ভেবে দেখার আছে। ভ্যাকসিনগুলো যেরূপ তাড়াহুড়া করে বের করা হয়েছে তাতে অনেকে অবাক হয়ে ভাবছেন যে ওষুধ কোম্পানিগুলো ও তাদের গবেষণা সহযোগীরা মানবদেহে নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনীয় যেসব ধাপ আছে সেগুলো তারা ডিঙ্গিয়ে গেছেন কিনা। বেশিরভাগ ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও একেক দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশিত কঠোর প্রটোকলগুলো মেনে চলার পক্ষপাতী। প্রাক-ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় ভ্যাকসিনের বিষাক্ততা ও প্রাণীদেহে কার্যকারিতা যাচাই করা হয়। সেই পরীক্ষার ব্যাপারটি ছাড়াও মানবদেহে যখন টিকার কার্যকারিতা দেখা হয় তখন নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা যাচাইয়ে তিন ধাপ বিশিষ্ট এক কঠোর প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। প্রতিটি ধাপে পরীক্ষার ফলাফল কি হচ্ছে না হচ্ছে তা স্বাধীন নিরপেক্ষ কমিটি কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করে। ভারতের বিশিষ্ট রোগজীবাণু বিজ্ঞানী শহীদ জামিল অবশ্য বলেন যে ভ্যাকসিন তৈরির সময়কালকে একেবারে কমিয়ে আনার মানে এই নয় যে এর গুণগত মান বা মানবদেহের জন্য নিরাপদ হওয়া না হওয়ার বিষয়টি বিসর্জন দেয়া হচ্ছে। ফাস্ট ট্র্যাকিং বা দ্রুত এগিয়ে নেয়ার কাজটা বহুলাংশে ঘটে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের ক্ষেত্রে যেখানে সিদ্ধান্ত নিতে কয়েক বছর লেগে যায়। তাছাড়া বেশ কিছু পর্যায় আছে যেগুলো একটার পর একটা অনুসরণ না করে সমান্তরালভাবে করতে দেয়া হয়। অথচ এতে নিরাপত্তা দিকটির ওপর কোন বিরূপ প্রভাব পড়ে না।

অবশ্য ডিএনএ ও আরএনএর মতো জিনপ্রযুক্তি ভ্যাকসিন তৈরির কাজে যেহেতু প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হচ্ছে উদ্বেগটা সেজন্যই দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে যে সেফটি প্রটোকল এতদিন অনুসরণ করা হয়ে আসছে এমন ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে তা হয়ে পড়েছে সেকেলে- যেখানে দরকার নতুন ধরনের সেফটি প্রটোকল। এমন অভিযোগও আছে যে অনেক কোম্পানি তাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল প্রচলিত রেওয়াজ অনুযায়ী এমন সব জার্নালে প্রকাশ করেনি যেগুলো নামী ব্যক্তিদের দ্বারা পর্যালোচনা হয়ে থাকে। এর পরিবর্তে তারা পরীক্ষার ফলাফল জনসমক্ষে প্রকাশ করেছে অথচ এর বিস্তারিত বিবরণ দেয়নি। ভ্যাকসিনের নিরাপত্তাগত দিক বা কার্যকারিতা সম্পর্কে এটুকু বলা যায় যে টিকা গবেষণার প্রটোকল বা ডিজাইন সম্পর্কে বাইরের এখনও কেউ কিছু জানে না। কাজেই লোকে জেনে শুনে তাদের পছন্দমতো সিদ্ধান্ত নেবে এমনটা কিভাবে আশা করা যায়। কয়েক বছর আগে মর্নিং সিকনেসের চিকিৎসার জন্য গর্ভবতী মহিলাদের থালিডোমাইড নামে এক ওষুধ দেয়া হয়েছিল। এতে বেশ কিছু ‘সিল বেবি’ অর্থাৎ হাত বা পা ছাড়া শিশু জন্ম নিয়েছিল। আন্তঃপ্রজন্মগত বা দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা তথ্য ছাড়া কোন ওষুধ বা ভ্যাকসিন দেয়ার এটাই হচ্ছে বিপদ।

টিকা নিয়ে এমন উদ্বেগের জন্ম হয় একটা ঘটনার পর। ভারতে অস্ট্রাজেনেকা/অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়/সিরাম ইনস্টিটিউটের ভ্যাকসিন ট্রায়ালে অংশ নেয়া জনৈক ব্যক্তি এক ডোজ টিকা নেয়ার পর তার নিউরোলজিক্যাল সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ করে এবং ৫ কোটি রুপীর ক্ষতিপূরণ মামলা করার হুমকি দেয়। বলাবাহুল্য ট্রায়াল প্রটোকলের অংশ হিসেবে ভলান্টিয়ারদের প্রকৃত ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে নাকি প্লাসিবো দেয়া হচ্ছে তা তাদের জানানো হয় না। অবশ্য একটি নিরপেক্ষ কমিটি ঘটনার তদন্ত করে দেখছে। তবে সিরাম ইনস্টিটিউটও সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে একশ কোটি রুপী মানহানির পাল্টা মামলা করার হুমকি দিয়েছে।

ভ্যাকসিনের নিয়ন্ত্রণ ও বিতরণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকা জরুরী। বৃহৎ ওষুধ কোম্পানিগুলোর মুনাফা লোটার কাজে সাধারণ মানুষকে গিনিপিগ বানানো হচ্ছে না জনসাধারণের মধ্যে এই আশ্বস্তভাব থাকা দরকার। অতীতে এমন ঘটনা বেশ কিছু ঘটেছে যে ভ্যাকসিন ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার ধাপ পার হয়েছে এবং লাইসেন্সও পেয়েছে অথচ গণহারে প্রয়োগ করার সময় অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে।

দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায় ২০১৭ সালে ফিলিপিন্সের স্কুলের ছেলেমেয়েদের ডেঙ্গু ভাইরাসের টিকা দেয়া হলে কয়েকটি শিশু মারা যায়। এ নিয়ে তদন্ত হলে এন্টিবডি-ডিপেনডেন্ট এনহ্যান্সমেন্ট নামক একটি অবস্থার সম্ভাবনার কথা উঠে আসে। যেখানে ডেঙ্গুর দ্বিতীয় আক্রমণ প্রথমটির তুলনায় ভয়াবহ সেখানে ভাইরাসের স্বাভাবিক সংক্রমণের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গোড়ার দিকে এই ভ্যাকসিনটি সেসব স্থানে ব্যবহারের সুপারিশ করেছিল যেখানে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অতি সচরাচর ঘটে। তার ফলে এমন ঘটনা হবে বিরল। কিন্তু এর পর হু তার সুপারিশ পরিবর্তন করে বলে যে ভ্যাকসিন নেয়া প্রত্যেক ব্যক্তির রক্ত পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে আগে অন্তত একবার তার স্বাভাবিক উপায়ে ডেঙ্গু হয়েছিল। তাহলে এন্টিবডি-ডিপেনডেন্ট এনহ্যান্সমেন্ট হবে না।

২০০৯ সালে ইউরোপে ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা এইচ১এন১ দেয়া হয়। ৩ কোটিরও বেশি ডোজ প্রয়োগ করা হয়েছিল। এদের মধ্যে একশরও বেশি ব্যক্তির ক্ষেত্রে নরকোলেপ্সি নামে ঘুমের মারাত্মক ব্যাঘাত সমস্যা দেখা দেয়। পরবর্তী তদন্তে প্রকাশ পায় যে ঠিক ভ্যাকসিনের জন্য এই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল তা নয়, ভ্যাকসিনের ইমিউন প্রতিক্রিয়া বাড়িয়ে তুলে এমন এক উপাদানের জন্যই এই সমস্যাটা হয়েছে এবং এটা ঘটেছে শুধু সেসব ব্যক্তির ক্ষেত্রে যাদের একটা নির্দিষ্ট জেনেটিক পটভূমি আছে। ভ্যাকসিনটি এখনও ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে তার মধ্যে এ উপাদানটি নেই। এসব দৃষ্টান্ত থেকে দেখা যায় যে কোন ভ্যাকসিন নিরাপদ কিনা সেই বাস্তব পরীক্ষাটি তখনই হয় যখন ঐ ভ্যাকসিন ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রয়োগ করা হয়। তবে ভ্যাকসিনের লাভ-ক্ষতি, সুবিধা-অসুবিধা গোটা প্রক্রিয়ারই অংশ। পোলিও টিকা দেয়া প্রতি ২৭ লাখ শিশুর মধ্যে একজনের পোলিও দেখা দিতে পারে। কারণ ভ্যাকসিনের ভাইরাস সেই রোগ ঘটাতে সক্ষম হয়। তারপরও পোলিও ভ্যাকসিনের প্রয়োগ চলছে এবং এর ফলে বিশ্বব্যাপী পোলিও প্রায় দূরই হয়ে গেছে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে একশ’ ভাগ নিরাপদ কিংবা একশ’ ভাগ কার্যকর বলে কিছু নেই। সাধারণ জ্বরের ক্ষেত্রে যে পারাসিটামল সেবন করা হয় সেটির ক্ষেত্রেও একথা সত্য।

ভ্যাকসিন নিরাপদ কি নিরাপদ নয় সেই প্রশ্নটি ছাড়াও এটা কার্যকর কি কার্যকর নয় সেটাও এক মস্ত ইস্যু। কোভিড-১৯ এর একটি আদর্শ ভ্যাকসিনের তিনটি জিনিস প্রতিরোধ করা উচিত। প্রথমত, খোদ রোগটিকে প্রতিরোধ, দ্বিতীয়ত, ইনফেকশন প্রতিরোধ এবং তৃতীয়ত, ট্রান্সমিশন বা সংক্রমণ প্রতিরোধ। তার মানে কারোর ভ্যাকসিন দেয়া না থাকলে সে যত ভাইরাস ছড়াবে, ভ্যাকসিন পাওয়া ব্যক্তি সংক্রমিত হলে কম ভাইরাস ছড়াবে।

আমরা যদিও জানি সংক্রমণ থাকা সত্ত্বেও ভ্যাকসিন রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। তবে আমরা যা জানি না তা হলো কতদিন সেই ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্থায়ী হবে। ফ্লু ও নিউমোনিয়ার মতো শ্বাসযন্ত্র আক্রমণকারী ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য দৃষ্টে বলা যায় যে এই ভ্যাকসিনগুলো বার বার দিতে হবে যদিও ভ্যাকসিনের কার্যকরিতার স্থায়িত্বকাল এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য কিনা তা দেখতে হবে। কারণ এই ভাইরাসটির বয়স এক বছরেরও কম। এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি যে একবার কোভিড-১৯ এ সংক্রমিত হয়েছে এমন ব্যক্তি পুনরায় সংক্রমিত হতে পারে কি না। কোভিড-১৯ এ সংক্রমিত হয়েছে এমন সাড়ে ৬ কোটি ব্যক্তির মধ্যে মাত্র ২৫ জনের পুনরায় সংক্রমিত হবার খবর পাওয়া গেছে। এই সংখ্যাটিকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বলা চলে। এটাই খানিকটা আশ্বস্তকর। কিন্তু তাতে এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনগুলোর গুরুত্ব কিছুমাত্র ক্ষুণ্ন হয়ে যায় না।

সূত্র : ইন্ডিয়া টুডে

আরো সংবাদ