স্বাধীনদেশ টেলিভিশন

চরম সংকটে লেবানন প্রবাসীরা, যেনো দেখার কেউ নেই!

দুই বছর ছয় মাস ধরে লেবাননে আছেন মোহাম্মদ সাজেদ। এরই মধ্যে পেটের জটিল অসুখে ধরে তাকে। তবে প্রায় এক বছর ধরে বেকার থাকায় চিকিৎসাও করতে পারছেন না ঠিক মতো। কিন্তু অপারেশন ছাড়া কোনও উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়ে দেশ থেকে টাকা নিয়ে অপারেশন করিয়েছেন সাজেদ। সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে খেয়ে না খেয়ে কোনোরকমে দিন কাটাচ্ছেন এই প্রবাসী। দেশে ফেরার প্রবল ইচ্ছা থাকলেও টাকা অভাবে তার ফেরা হচ্ছে না।

শুধু মোহাম্মদ সাজেদ নয়, লেবাননে বেশিরভাগ প্রবাসীর অবস্থা প্রায় একই রকম। দেশটিতে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিকভাবে খারাপ সময় পার করছেন লেবাননে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। লেবাননে ডলার সংকট দেখা দেওয়ায় মূল্যহীন হয়ে পড়ছে লেবাননের মুদ্রা লিরা।

লেবাননে অবস্থানরত প্রবাসীরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের মহামারির চেয়ে বেশি সংকট তৈরি করেছে দেশটির চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা। দেশটির মুদ্রা লিরা মান হারাচ্ছে। আগে যেখানে ১৫০০ লিরায় এক ইউএস ডলার পাওয়া যেতো, এখন এক ইউএস ডলার পেতে লাগে আট হাজার লিরা। এমনকি লিরা দিলেও দেশটির বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর লিরার বিপরিতে ডলার দিতে পারছে না। আমদানি নির্ভর দেশটিতে বেশিরভাগ জিনিস কিনতে হলে লাগে ডলার। কিন্তু ডলার না থাকায় বিপর্যয়ে দেশটির অর্থনীতি।

প্রবাসীরা জানিয়েছেন, দেশটির নাগরিকরা নিজেরাই অর্থনৈতিক সংকটে। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন বেশিভাগ প্রবাসী। দেশটিতে থাকা বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা ইতোমধ্যে নিজ নিজ দেশে ফেরত চলে যাচ্ছেন। এর মধ্যে যারা কাজ পাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই পাঁচ-ছয় লাখ লিরার বেশি বেতন পাচ্ছেন না। আগে ডলারে বেতন পেলেও এখন লিরায় বেতন দেওয়া হচ্ছে। ফলে বাজারে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে প্রবাসীদের। এমন পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে আসতে চান প্রবাসীরা।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এক লাখ ৫০ হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন লেবাননে। তবে কতজন দেশটিতে অবৈধভাবে আছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই দেশটিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে। অনেকের ধারণা, দেশটিতে কমপক্ষে ৫০ হাজার প্রবাসী আছেন যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই। দেশটিতে দোকান, বাসাবাড়িতে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন বাংলাদেশিরা। তবে করোনা ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশটিতে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। প্রবাসীরাও কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। এ কারণে অনেকেই দেশে ফিরে আসতে চান।

এদিকে ২০ ডিসেম্বর এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে স্বেচ্ছায় দেশে ফিরতে ইচ্ছুক অবৈধ হয়ে পড়া বাংলাদেশিদের জন্য জন্য রেজিস্ট্রেশন শুরু করেছে লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাস। দূতাবাস জানিয়েছে, রেজিস্ট্রেশন করতে ফি অথবা জরিমানা বাবদ এক লাখ ৪০ হাজার লেবানিজ লিরা এবং উড়োজাহাজের টিকিট বাবদ ৪০০ মার্কিন ডলার জমা করতে হবে। তবে এত টাকা ফি নির্ধারণ করায় আন্দোলন করেন প্রবাসীরা। তারা দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করেন।

এরপর সোমবার (২৮ ডিসেম্বর) দূতাবাস জানায়, স্বেচ্ছায় দেশে ফেরার জন্য যারা নাম নিবন্ধন করছেন, দূতাবাসের প্রচেষ্টায় জেনারেল সিকিউরিটি দেশে ফেরার জন্য তাদের এক লাখ চল্লিশ হাজার লিরা ফি ধার্য করেছিল তা মওকুফ করে দিয়েছে। যারা নাম নিবন্ধন করবেন তাদের এ ফি দিতে হবে না। যাদের কাছ থেকে গত ২৫ হতে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক লাখ ৪০ হাজার লিরা ফি গ্রহণ করা হয়েছিল, তা ফেরত দেওয়া হবে।

প্রবাসী শ্রমিক মো. মাসুদ বলেন, ‘আমি আট লাখ লিরা বেতন পাই। মানে ১০০ ডলারের মতো। কিন্তু ব্যাংকে গেলে আর ডলার আর পাওয়া যায় না। ২০ কেজির চালের বস্তা কিনতে খরচ হয় এক লাখ ৩০ হাজার লিরা। বস্তির মতো ছোট ছোট রুমে তিন-চার জন মিলে থাকে সবাই। বাসা ভাড়া দুই লাখ-তিন লাখ লিরা। এখানে বেঁচে থাকাটাই কঠিন। আমরা দেশে ফিরতে চাই। কিন্তু এত টাকা বিমান ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য তো আমাদের নেই।’

বিমান ভাড়া বাবদ ৪০০মার্কিন ডলার জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়েছে প্রবাসীদের। অন্যদিকে লিরা থাকলেও অনেকেই ডলার জোগাড় করতে পারছেন না। মো. তন্ময় নামের আরেক প্রবাসী শ্রমিক বলেন, ‘আগে আমার বেতন পেতাম ডলারে, এখন দেয় লিরায়। আগে যেখানে ৮০০ ডলার বেতন দিতো, এখন মাসে ১০০ ডলার আয় করাও কঠিন। যেখানে সবার খাওয়ার খরচ জোগাড় করতে পারেছ না, সেখানে বিমান ভাড়া ৪০০ ডলার জোগাড় করা খুবই কঠিন।’

এ বিষয়ে লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাসের কোনও কর্মকর্তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আরো সংবাদ