প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বরের রাতটিকে বিশ্বের অনেক দেশে থার্টিফার্স্ট রাত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ইদানীং আমাদের দেশেও এ রাতটি ওই নামে আখ্যায়িত হচ্ছে। যদিও ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের রেওয়াজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও আগে থেকে চলে আসছে। কিন্তু গত কয়েক বছর থেকে বর্ষবরণের সঙ্গে সঙ্গে যোগ হয়েছে এ নতুন কথাটি ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’, যা হয়তো ৩০ বছর আগে মানুষ শোনেনি।
‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ এটি মুসলিমদের আবিষ্কার করা কোনো কথা নয়। বরং এটি সর্বপ্রথম অমুসলিমরাই আবিষ্কার করেছে। তারা কীভাবে এ রাতটি উপভোগ করে? একেক দেশে একেক সংস্কৃতির মাধ্যমে বর্ষবরণ অনুষ্ঠিত হয়। একজন অন্যজনের গায়ে পানি ছিটিয়ে থাইল্যান্ডের উৎসব, আঙুর খেয়ে স্পেনের উৎসব, নববর্ষের শুরুতে ঘুমালে চোখের ভ্রু সাদা হয়ে যায়, সে কারণে শুরুর সময়টাতে না ঘুমিয়ে কোরিয়ানদের উৎসব, রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ১২টি ঘণ্টা বাজানোর মাধ্যমে মেক্সিকোর উৎসব, ভোর হওয়ার সঙ্গে শিক্ষকদের কাছে র্দীঘায়ু কামনা করে ভিয়েতনামের উৎসব, পরিবারের সব সদস্যের একত্রে রাতে আহার করার মাধ্যমে আর্জেন্টিনা উৎসব, সাদা পোশাক পরিধান করে ব্রাজিলবাসীর উৎসব পালিত হয়। এ আবিষ্কারকদের উৎসব পালনের পদ্ধতিগুলোর কোনোটাই আমাদের ধর্ম ইসলাম কিংবা আমাদের বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
আমরা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র, আমাদের দেশে এ রাত পালন হচ্ছে নাচ, গান, বেহায়াপনা এবং চরম অশ্লীলতার লেটেস্ট রূপ ডিজে পার্টির মাধ্যমে। দুঃখজনক হলেও বাস্তব হলো, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মর্ডান হওয়ার নামে তরুণ-তরুণীরা এ রাতে ধর্ম ও সমাজবিরোধী কাজে মাতোয়ারা হচ্ছে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন ‘দুই শ্রেণির জাহান্নামি রয়েছে, যাদের আমি এখনও দেখিনি। এমন সম্প্রদায়, যাদের হাতে গরু পরিচালনা করার লাঠি থাকবে। তা দ্বারা তারা মানুষকে প্রহার করবে। আর নগ্ন পোশাক পরিধানকারী নারী, যারা পুরুষদেরকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করে এবং নিজেরাও পুরুষের দিকে আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথা বক্র উঁচু কাঁধ বিশিষ্ট উটের মতো। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। অথচ এর সুগন্ধি এত এত দূর থেকে পাওয়া যায়।’ (মুসলিম : ২১২৮)।
আরও নানা যৌক্তিকতায় এ রাত আমরা পালন করতে পারি না। প্রথমত, আমরা মুসলিম হিসেবে আমাদের জীবনের সবকিছুই হতে হবে ইসলামের আলোকে, অথচ এ ইসলাম তার নিজস্ব বর্ষবরণ অর্থাৎ আরবি বর্ষবরণের কথাও তার কোনো অনুসারীকে বলেনি। দ্বিতীয়ত, রাত ও দিন আল্লাহর সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত, তাই তাঁর সৃষ্টিকে তাঁর বিধান মোতাবেক ব্যবহার ভোগ- উপভোগ করাই সমীচীন।
বছরের শেষ রাতে যেখানে আত্মসমালোচনা ও মৃত্যু নিয়ে চিন্তা করা দরকার, সেখানে বেলেল্লাপনার মধ্য দিয়ে ৩১ ডিসেম্বর রাত উদযাপন মেনে নেওয়া যায় না। রাত সম্পর্কে সুরা আন-নাবার ১০-১১ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রাতকে করেছি আবরণ আর দিনকে করেছি জীবিকা অর্জনের সময়।’ আল্লাহ তায়ালা সুরা ইউনুসের-৬৭ নং আয়াতে আরও বলেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য তৈরি করেছেন রাত; যেন তোমরা তাতে প্রশান্তি লাভ করতে পার, আর দিন দিয়েছেন দর্শন করার জন্য।’ অনুরূপভাবে সুরা আল-কাসাসের ৭৩ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তিনিই স্বীয় রহমতে তোমাদের জন্য রাত ও দিন করেছেন, যাতে তোমরা তাতে বিশ্রাম গ্রহণ ও তাঁর অনুগ্রহ অন্বেষণ কর এবং তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ সুরা আল-মুযযাম্মিলের ১-৩ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে বস্ত্রাবৃত, রাত্রিতে দ-ায়মান হোন কিছু অংশ বাদ দিয়ে, অর্ধরাত্রি অথবা তদপেক্ষা কিছু কম অথবা তদপেক্ষা বেশি।’
তাহলে এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে, রাতের মূল কাজ হলো মানুষ আরাম করবে এবং রাতের কিছু অংশ আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত করবে। হাদিসে রাত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন ‘রাতের এক-তৃতীয়াংশ বাকি থাকতে আমাদের রব পৃথিবীর নিকটবর্তী আকাশে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেন কে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব, কে আমার কাছে কিছু চাইবে আমি তাকে তা দেব, কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করব, এভাবে ফজর হওয়া পর্যন্ত তা চলতে থাকে। (বোখারি ১১৪৫; মুসলিম : ৭৫৮)। মহান আল্লাহ যখন মানবম-লীকে এভাবে আহ্বান করতে থাকে, তখন কেউ কি করে অশ্লীলতা এবং বেহায়াপনায় মগ্ন থাকতে পারে?
অতএব, আমাদের উচিত আল্লাহকে ভয় করা এবং অন্যায়-অশ্লীলতা থেকে বিরত থেকে জীবনকে আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় অতিবাহিত করা। এ রাত্রি উদযাপন করা থেকে নিজেকে ও পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্তুতিকে বাঁচিয়ে রাখা। কারণ এ জাতীয় উৎসব পালন সমাজ ও ইসলামবিরুদ্ধ এবং বিজাতীয় সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণমাত্র। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন ‘যে কেউ অন্য কোনো জাতির সামঞ্জস্যতা বিধান করবে, সে তাদের মধ্যে গণ্য হবে।’ (আবু দাউদ : ৪০৩১)।
লেখক : আবদুল্লাহিল হাদী মু. ইউসুফ