স্বাধীনদেশ টেলিভিশন

কাজে ফেরা নিয়ে রেমিটেন্স যোদ্ধাদের শঙ্কা !

গত বছর প্রবাসফেরতদের নিয়ে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা- আইওএম’র করা একটি জরিপের ওপর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে প্রবাস ফেরতদের প্রায় ৭০ শতাংশই জীবিকাহীন।

মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে উপার্জন ব্যবস্থা, সামাজিক সেবা ও স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সহায়তার নেটওয়ার্কের অভাবে হাজারো অভিবাসী কর্মী প্রবাসে যে দেশে কাজ করছিলেন, সেখান থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। অথচ গড়ে একেকজন প্রবাসী তার পরিবারের তিনজন সদস্যকে সহায়তা করে থাকেন।

অদৃশ্য করোনাভাইরাসের কারণে দেশে ফিরে আসা প্রবাসীরা দেশেও কোনো কাজ করতে পারছেন না। পরিবার নিয়ে চরম অর্থকষ্টে দিনানিপাত করছেন রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। তাদের কেউ কেউে এখন বাধ্য হয়ে পরিবার চালাতে রাজমিস্ত্রি কেউবা মাটি কাটার কাজ করছেন। এমন কয়েকজন প্রবাসীর সঙ্গে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের।

মিয়া মোরশেদ নামে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার এক প্রবাসী জানান, দুই বছরের কিছু সময় আগে তিনি মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। পরবর্তীকালে বাবা অসুস্থ হওয়ায় ছুটি নিয়ে গত বছরের ১৬ জানুয়ারি দেশে আসেন। ২০ মার্চ তার ফিরতি ফ্লাইট ছিল। কিন্তু ১৭ মার্চ ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়ায় তিনি আর যেত পারেননি। এর মধ্যে তার বাবাও মারা যান।

তিনি জানান, পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় বাবার মৃত্যুর পর আট সদস্যের পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পরে তার ওপর। আশায় ছিলেন ফ্লাইট খুললে মালয়েশিয়ায় যাবেন। কিন্তু তার সে আশা আর পূরণ হয়নি। এর মধ্যে গত অক্টোবরে ভিসার মেয়াদও ফুরিয়ে গেছে। ফলে দেশেই কিছু করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু করতে পারছিলেন না। পরিবার চালাতে বাধ্য হয়ে এখন মাটি কাটার কাজ করছেন তিনি।

মোরশেদ বলেন, ‘এক বছরের বেশি সময় হয়ে গেছে আমি দেশে আছি। যদি বিদেশে যেতে পারতাম তাহলে হয়তো একটু ভালোভাবে থাকতে পারতাম। এখন আর যাওয়ার কোনো আশা-ভরসা নেই। দুই বছর বিদেশে ছিলাম, এ সময়ে তো আর কিছু করা যায় না। জমানো টাকাও নেই যে কিছু একটা করে খাবো। যখন যে কাজ পাচ্ছি সেটাই করছি।’

মঈনুল ইসলাম মৌলভীবাজার জেলার বাসিন্দা। দীর্ঘ দুই দশক ধরে আছেন ইংল্যান্ডে। থাকেন সেন্ট্রাল লন্ডন। তিন সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে তাদের পাঁচ জনের সংসার। এই দুই দশকে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে দেশে এসেছেন কয়েকবার। কিন্তু অন্যবারের চেয়ে এবার সম্পুর্ণ আলাদা। করোনা মহামারীর কারণে যেতে সমস্যা হচ্ছে তাদের।

মইনুল ইসলাম জানান, করোনায় সব উলট পালট হয়ে যাচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিন সপ্তাহের জন্য এসেছিলাম, এখন হয়ে যাচ্ছে প্রায় দুই মাস। ইংল্যান্ডের অবস্থা খারাপ এজন্য টিকেট পিছিয়েছি। আগামী মাসে চেষ্টা করছি যাওয়ার।

রাসেল আহমদ মৌলভীবাজার জেলার রাজনগরের বাসিন্দা। স্ত্রী সন্তান, মা-বাবা, ভাই-বোনকে নিয়ে সংসার। এক যুগ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে চাকরি করছেন। সেখানকার একটি মাছের আড়তে কাজ করেন,রোজগারও ভালো। ২০২০ এর মার্চে এসেছিলেন দেশে, আর যেতে পারেন নি। করোনার কারণে এমনটি হয়েছে বলে জানান তিনি।

রাসেল আহমেদ বলেন, এক বছরের কাছাকাছি হয় আসছে, এখনও যেতে পারছি না। আমার কফিল (কাতারের শেখ) স্বাক্ষর দিয়ে একটি পেপার পাঠানোর কথা। এখন পর্যন্ত পাঠাতে পারেন নি। এদিকে ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমার অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। যদি শেষ পর্যন্ত যেতে না পারি তাহলে খুবই বিপদে পড়ব।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তত তিন লাখ মানুষ ইউরোপ-আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকেন। তাদের রক্ত-ঘামে অর্জিত টাকা দিয়েই দেশে পরিবার চলে। কিন্তু এই মানুষগুলোই এখন নিজ দেশে এসে কষ্টে জীবনযাপন করছেন।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকেই কয়েক হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি দেশে ফিরে আসেন। তাদের কেউ কেউ বিদেশে চাকরি হারিয়ে একেবারে চলে এসেছেন, আবার কেউ কেউ ছুটিতে এসে করোনাভাইরাসের কারণে আর ফিরে যেতে পারেননি। প্রবাসে জীবিকার একমাত্র উৎসটুকু হারিয়ে দেশে এসে চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের।

বিজয়নগর উপজেলার বাসিন্দা রইছ উদ্দিন জানান, তিনি পাঁচ বছর আগে সৌদিআরব পাড়ি জমান। সেখানে একটি বিপণী বিতানে কাজ করতেন। প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় হতো তার। এ টাকা দিয়েই দেশে আট সদস্যের পরিবারের খরচ চলত। আগে দেশে আসলে এলাকার লোকজন নানাভাবে খাতির-যত্ন করতো। অথচ করোনাভাইরাসের কারণে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে আসার পর লোকজন এখন আর কাছে আসে না। অনেক চেষ্টা করেও কোনো কাজ যোগাড় করতে না পেরে এখন দিনমজুরি করেন। যখন যে কাজ পান সেটাই করেন পরিবার চালান।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রবাসফেরত কল্যাণ সমিতির সহসভাপতি শফিকুল আলম স্বপন বলেন, ‘শুধুমাত্র পরিবারের সুখের জন্য প্রবাসীরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রক্ত পানি করে টাকা উপার্জন করেন। তাদের উপার্জিত অর্থে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। অথচ করোনাভাইরাসের কারণে এই রেমিট্যান্স যোদ্ধারাই নিজ দেশে অমানবিক কষ্টে দিনানিপাত করছেন। প্রবাসীদের প্রবাসে যেমন কষ্ট, তেমনি নিজ দেশেও কষ্ট।’

একই চিত্র দেখা গেছে ফেনীতে। জেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের রতন দেবনাথ বলেন, ‘দীর্ঘ ১০ বছর সৌদি আরব ছিলাম, কিন্তু করোনা মহামারিতে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হই, এখন আর যেতে পারব কি না জানি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিন বিদেশ থাকার ফলে এখন দেশে এসে কোনো কাজও করতে পারছি না, জানি না কীভাবে চলবো?’

ফেনী জেলার শর্শদী ইউনিয়নের বারেক মিয়া বলেন, ‘করোনা আমার সব শেষ কইরা দিসে, করোনার আগে ছুটিতে কুয়েত থেইকা আইছিলাম, কিন্তু এখন আর যাইতে পারতেছি না। আল্লাহই জানেন কি হইবো।’

কী বলছে জরিপ

গত বছরের জুলাইয়ে প্রবাসফেরতদের নিয়ে করা ব্র্যাকের একটি সমীক্ষা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ৫৫৮ জন কর্মীর ওপর পরিচালিত ব্র্যাকের ওই জরিপ বেলছে, জরিপে অংশ নেওয়া ৯১ শতাংশ বলেছেন তারা এখনো কোনো সরকারি বা বেসরকারি সহায়তা পাননি। ৮৭ ভাগ বলেছেন তাদের অন্যকোনো আয়ের উৎস নেই। ৬০ ভাগ বলেছেন তারা যে জমানো টাকা নিয়ে এসেছেন তা খরচ হয়ে গেছে। ৭৪ শতাংশ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন।

ব্র্যাকের হিসেব অনুযায়ী লকডাউনের আগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশের বাইরে থেকে সাড়ে চার লাখ বাংলাদেশি ফিরে এসেছেন। এরমধ্যে দেড় থেকে দুই লাখ প্রবাসী শ্রমিক। তাদের মধ্যে সৌদি আরব থেকে ৪১ হাজার, আরব আমিরাত থেকে ৩৮ হাজার। মালয়েশিয়া থেকে ১৯ হাজার ফিরে এসেছেন।

জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি- বায়রার মতে, করোনার কারণে দেশে ফিরে চরম আর্থিক সংকটে পড়েছেন অধিকাংশ প্রবাসী শ্রমিক।

কী ভাবছে সরকার?

প্রবাসফেরত শ্রমিকদের যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী দেশেই কর্মসংস্থানসহ পুনর্বাসনের সুপারিশ করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। প্রবাস থেকে ফেরত এসে লাখো কর্মী মানবেতর জীবন যাপন করছে- যা ওই কমিটির সদস্যদের ভাবিয়ে তুলেছে।

গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) জাতীয় সংসদ ভবনে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে দেশে ফেরা প্রবাসী শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। কমিটির একাধিক সদস্য তাদেরকে আর্থিক প্রণোদনা দেয়াসহ বিকল্প উপায়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য তাগিদ দেন।

কমিটির সভাপতি মুজিবুল হকের সভাপতিত্বে বৈঠকে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, শাজাহান খান, শামসুন নাহার এবং মো. আনোয়ার হোসেন (হেলাল) উপস্থিত ছিলেন।

তারা বলেন, বিশ্বজুড়ে করোনার মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। নতুন করে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দিচ্ছে বহু দেশ। অবস্থা উত্তরণ কবে ঘটবে কেউ বলতে পারছেন না।

এ অবস্থায় চাইলেও অনেক শ্রমিকের পক্ষে কর্মস্থলে ফিরে যাওয়া সম্ভব না। ফলে তাদের জীবনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে না দিয়ে একই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন।

এ জন্য মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও বলেছে সংসদীয় কমিটি। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বৈঠকে জানানো হয়, করোনার কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে কাজ হারিয়ে প্রবাসী শ্রমিকদের দেশে ফেরত আসা এখনও অব্যাহত রয়েছে।

চলতি বছর ১ এপ্রিল থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ লাখ ৯৭ হাজার ৯৮৪ পুরুষ এবং নারী ৪৩ হাজার ৭৭৪ জন নারী শ্রমিক দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। এ ছাড়া আউটপাস নিয়ে দেশে এসেছেন ৪১ হাজার ৫৮৯ জন।

বৈঠকে জানানো হয়, করোনায় বিশ্ব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এই শ্রমিকরা যাতে আবার তাদের কাজের জায়গায় ফিরতে পারেন, সে জন্য কাজ করছে সরকারের কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি।

এ ছাড়া করোনার প্রকোপের কারণে যেসব প্রবাসী শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে ইতোমধ্যে ২০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার।

প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে এ টাকা দেয়া হবে। প্রত্যাগত শ্রমিক বা তাদের পরিবারের সদস্যরা সর্বোচ্চ মাত্র চার শতাংশ সুদে এক লাখ টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন।

এ ছাড়া বাজেটে প্রবাসীদের জন্য বাড়তি আরও ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। সংসদীয় কমিটি দেশে ফেরত আসা শ্রমিকদের দুর্দশা লাঘবে সরকারের এই উদ্যোগ যাতে স্বচ্ছতা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়, এমন পরামর্শ দিয়েছে।

জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি- বায়রা মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী গত ডিসেম্বরে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ফেরত আসা শ্রমিকদের পুনর্বাসনে দক্ষতা অনুযায়ী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোয় কাজের সুযোগ দিতে হবে। তারা যদি উদ্যোক্তা হতে চান তা হলে তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।’

আরো সংবাদ