স্বাধীনদেশ টেলিভিশন

ঋণ ফেরত দিতে না পেরে সম্পত্তি হারাচ্ছেন অনেক প্রবাসী: সমীক্ষা

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকার যে ব্যয় বেঁধে দিয়েছে তার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই, আড়াই গুণ বেশি টাকা দিতে হচ্ছে শ্রমিকদের।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকার যে ব্যয় বেঁধে দিয়েছে তার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই, আড়াই গুণ বেশি টাকা দিতে হচ্ছে শ্রমিকদের।

নিজের ও পরিবারের ভাগ্য ফেরানোর আশায় ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ঋণ করে বা সম্পদ জামানত রেখে যারা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, তাদের মধ্যে ১৩ শতাংশ প্রবাসী ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে সম্পত্তি হারিয়েছেন বলে একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রথমবারের মতো ‘অভিবাসন ব্যয় জরিপ’ শিরোনামে এই সমীক্ষা চালিয়েছে। এজন্য গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে ওই বছরগুলোতে বিদেশে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তারা।

জরিপ প্রতিবেদনটি সম্প্রতি বিবিএসের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। তবে মহামারীর কারণে তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে বিবিএসের শিল্প ও শ্রম উইংয়ের পরিচালক ও প্রকল্প পরিচালক কবির উদ্দিন আহাম্মদ জানিয়েছেন।

প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বিদেশে পাড়ি জমানো আট হাজার প্রবাসীর পরিবারের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময়ে বিদেশে যাওয়ার জন্য যারা ঋণ করেছিলেন তাদের মধ্যে প্রায় ১২ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ কর্মী ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় জামানতের মালিকানা হারিয়েছেন। নারীদের মধ্যে জামানতের মালিকানা হারানোর হার ১৬ শতাংশ। সার্বিকভাবে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ অভিবাসী ঋণ ফেরত দিতে না পারায় জামানত হারিয়েছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই সময়ে বিদেশে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৭৮ শতাংশই ঋণ করেছেন। এসব ঋণ আত্মীয়স্বজন, এনজিও বা মহাজনদের কাছ থেকে নিয়েছেন।

এক্ষেত্রে নারীদের চেয়ে পুরুষরাই বেশি ঋণ নিয়ে বিদেশ গেছেন। ৮১ শতাংশ পুরুষ কর্মী আর ৫৬ শতাংশ নারী কর্মী ঋণ নিয়ে বিদেশে গেছেন।

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ৪১ শতাংশ প্রবাসী বন্ধু বা আত্মীয়স্বজন থেকে টাকা নিয়েছেন। আর পরিবারের কাছ থেকে অর্থ পেয়েছেন ২৮ শতাংশ, ২০ শতাংশ প্রবাসী এনজিওর কাছ থেকে এবং ১৫ শতাংশ প্রবাসী মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশ গেছেন।

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল সময়কালে বাংলাদেশ থেকে মোট ২৭ লাখ ৩ হাজার জন বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হয়েছেন। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ পুরুষ, আর নারী ১৫ শতাংশ (৪ লাখ)। এসব অভিবাসীর ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশের কোনও ধরনের বীমা নেই। আর বীমা আছে ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ পুরুষ এবং ৩০ দশমিক ৩ শতাংশ নারী অভিবাসীর।

বিবিএসের জরিপের তথ্য অনুযায়ী প্রবাসীদের সবচেয়ে বেশি আয় সিঙ্গাপুরে, মাসে ৪৬ হাজার ৮৯৫ টাকা।বিবিএসের জরিপের তথ্য অনুযায়ী প্রবাসীদের সবচেয়ে বেশি আয় সিঙ্গাপুরে, মাসে ৪৬ হাজার ৮৯৫ টাকা।জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে নারী ও পুরুষ মিলে প্রধান অভিবাসী গন্তব্য দেশ ছিল সৌদি আরব। তবে একজন অভিবাসীর সবচেয়ে বেশি খরচ পড়ে সিঙ্গাপুর যেতে।

অভিবাসনের ব্যয় সরকারের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) নির্ধারিত অভিবাসী খরচের সঙ্গে কোনও মিল নেই। সরকারের বেঁধে দেওয়া খরচের চেয়ে আড়াই গুণ খরচ হয় একজন অভিবাসীর। আর সেই অর্থ তুলে আনতেই লেগে যায় প্রায় ১৮ মাস।

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সব মিলিয়ে একজন অভিবাসীর বিদেশ যেতে গড়ে ব্যয় হয়েছে ৪ লাখ ১৬ হাজার ৭৮৯ টাকা। এর মধ্যে নারী কর্মীর গড় অভিবাসন খরচ ১ লাখ ১০২ টাকা, আর  পুরুষ কর্মীর অভিবাসীর খরচ ৪ লাখ ৭১ হাজার ৬৬৮ টাকা।

প্রকৃত খরচের সঙ্গে সরকার নির্ধারিত ব্যয়ের কোনো মিল নেই জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়,  সিঙ্গাপুর যেতে সরকার ২ লাখ ৬২ হাজার ২৭০ টাকা বেঁধে দিলেও বাস্তবে ব্যয় হচ্ছে ৫ লাখ ৭৪ হাজার ২৪১ টাকা। সৌদি আরবে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা বেঁধে দেওয়া হলেও বাস্তবে ব্যয় হচ্ছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৩৬৬ টাকা। মালয়েশিয়ায় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার জায়গায় লাগছে ৪ লাখ ৪ হাজার ৪৪৮ টাকা। কাতার যেতে ১ লাখ ৭৮০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে ব্যয় হচ্ছে ৪ লাখ ২ হাজার ৪৭৮ টাকা। ওমান যেতে ১ লাখ ৭৮০ টাকা ব্যয়ের কথা সরকারি হিসাবে থাকলেও বাস্তবে ব্যয় হচ্ছে ৩ লাখ ৮ হাজার ৪৭ টাকা।

এই ব্যয়ের মধ্যে গন্তব্য দেশে যাওয়ার বিমান ভাড়া, প্রশিক্ষণ, ঋণের সুদ পরিশোধ, নিয়োগকারীর ফি, ছাড়পত্র, ভিসা ফি, দালাল ফি, মেডিকেল, অভ্যন্তরীণ পরিবহন, পাসপোর্ট, কল্যাণ ফি ও দক্ষতা যাচাইয়ের খরচ ধরা হয়েছে।

বাস্তব চিত্রে দেখা গেছে, সরকারের বেঁধে দেওয়া ব্যয়র তুলনায় একজন অভিবাসীর গড় ব্যয় হচ্ছে আড়াই গুণ বেশি।

এত বেশি অর্থ ব্যয় করে বিদেশ যাওয়ার পরেও ৫৩ শতাংশ প্রবাসীর সঙ্গে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো চুক্তি হয়নি। যাদের চুক্তি হয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চুক্তি হয়েছে সিঙ্গাপুরের নিয়োগকারী কোম্পানির সঙ্গে। এরপরে যথাক্রমে মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব ও ওমানের কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চুক্তি হয়েছে।

জরিপের তথ্য বলছে, একজন অভিবাসী যে অর্থ ব্যয় করে বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিচ্ছেন তা গড়ে তার ১৭ দশমিক ৬ মাসের আয়ের সমান। এক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় নারী কর্মীরা এগিয়ে রয়েছেন। একজন নারী অভিবাসীর খরচ তুলতে গড়ে ৫ দশমিক ৬ মাস লাগলেও একজন পুরুষ কর্মীর সময় লাগছে গড়ে ১৯ মাস।

জরিপে অংশ নেওয়া প্রবাসীদের ২৬ শতাংশ বলেছেন, অবকাশ বা ছুটিতে তারা বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৫ শতাংশ বলেছেন, কাজের অনুমতির মেয়াদ শেষ হওয়ায় ফিরে এসেছেন। চাকরি পাওয়ার সুযোগ কমে যাওয়ার কথা বলেছেন ১৩ শতাংশ। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আয় কমে যাওয়ার কথা বলেছেন ১৪ শতাংশ।

এছাড়া গন্তব্য দেশে যাওয়ার পর একজন অভিবাসী কর্মীর মাসিক গড় আয় ২৯ হাজার ৮৫৫ টাকা। এর মধ্যে নারী কর্মীর মাসিক গড় আয় ২০ হাজার ২১১ টাকা, পুরুষ কর্মীর মাসিক গড় আয় ৩২ হাজার ৫৪২ টাকা।

প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি ৪৬ হাজার ৮৯৫ টাকা আয় করেন সিঙ্গাপুরে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গড় আয় ২৯ হাজার ৭২৩ টাকা মালয়েশিয়ায় এবং তৃতীয় ২৯ হাজার ১৭৪ টাকা আয় করেন কাতার প্রবাসীরা।

আরো সংবাদ