স্বাধীনদেশ টেলিভিশন

কারাগার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে নয় মাস যুদ্ধের পর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলেও ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে জাতি বিজয়ের পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করে। জাতির পিতা পাকিস্তান থেকে ছাড়া পান। পাকিস্তান থেকে লন্ডন হয়ে দিল্লি ঘুরে বাংলাদেশে পৌঁছান তিনি। ৮ জানুয়ারি থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত তার পুরো সময় আন্তর্জাতিক মিডিয়ার চোখ ছিল বঙ্গবন্ধুর গতিবিধির ওপর। সে সময়ের পত্রিকা ও বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে ছিলেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে টাইমলাইনটি তৈরি করা হয়েছে।

১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি ভোর রাতে ইংরেজি হিসাবে ৮ জানুয়ারি

এদিন বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেনকে বিমানে তুলে দেওয়া হয়। রাওয়ালপিন্ডি থেকে রয়টার্স বার্তা সংস্থার সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে লন্ডনে পৌঁছেছেন এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো বিমানবন্দরে শেখ মুজিবকে বিদায় জানান।

সকাল সাড়ে ৬টায় তারা পৌঁছান লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে। বঙ্গবন্ধুকে একটিবার দেখার জন্য হোটেল লবিতে ছুটে এসেছিলেন হাজারো জনতা।

বেলা ১০ টার পর তিনি কথা বলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ, তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।

বেলা ১টায় তিনি সংবাদ সম্মেলন করেন। এসময় ক্ল্যারিজ’স হোটেলের বলরুমে লিখিত বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী দেশ ও মানুষের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানান। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তিনি বিশ্বের সব দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন এক অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা।’

৯ জানুয়ারি ১৯৭২

ব্রিটেনের বিমান বাহিনীর একটি বিমানে করে দেশের পথে যাত্রা করেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বিশেষ বিমানে হিথ্রো বিমানবন্দর ছাড়ার পর বিবিসির মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ববাসী বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে যাত্রার বিষয়ে জানতে পারে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসার জন্য বিমান পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ সরকারের বিমানেই দেশে ফিরতে চাইলেন। লন্ডন থেকে তার সফরসঙ্গী হন ভারতের দুই কূটনীতিক ভেদ মারওয়া ও শশাঙ্ক ব্যানার্জি।

১০ জানুয়ারি ১৯৭২

এদিন সকালেই তিনি নামেন দিল্লিতে। সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সমগ্র মন্ত্রিসভা, প্রধান নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্যান্য অতিথি ও সে দেশের জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা লাভ করেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু ভারতের নেতৃবৃন্দ এবং জনগণের কাছে তাদের অকৃপণ সাহায্যের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান। তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা হিসেবে’।

১০ জানুয়ারি বেলা ১টা ৪১ মিনিটের দিকে বঙ্গবন্ধু ঢাকা এসে পৌঁছান। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পর বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানোর জন্য প্রাণবন্ত অপেক্ষায় ছিল। আনন্দে আত্মহারা লাখো মানুষ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তাকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানান। তেজগাঁ বিমান বন্দর থেকে ঢাকা রেসকোর্স পর্যন্ত মাত্র চার মাইল পথ ট্রাকযোগে অতিক্রম করতে তার দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে।

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বিকাল পাঁচটায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তিনি ভাষণ দেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেদিনই ব্রিটেনে ভারতীয় হাইকমিশনার আপা পন্থের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানিয়ে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। তাতে বলা হয়, ‘আপনি বন্দি ছিলেন, কিন্তু আপনার চিন্তাশক্তি ও চেতনাকে কারারুদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। আপনি নির্যাতিত জনগণের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।’

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে। কিন্তু তার সারা জীবনের সংগ্রাম ছিল সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। নতুন রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পুরো পথে থাকা শশাঙ্ক ব্যানার্জি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পুরো পথ বঙ্গবন্ধু অস্থিরতায় কাটিয়েছেন। তিনি চাইছিলেন দেশ পুনর্গঠনের কাজের পরিকল্পনা দ্রুত সেরে ফেলতে। হাসছিলেন, চোখে জলও এসেছে কয়েকবার। একজন নেতা দেশ ও তার জনগনকে এতটা ভালোবাসতে পারে, চোখের সামনে না দেখলে হয়তো বিশ্বাস করতাম না।

আরো সংবাদ