করোনাভাইরাসে এমনিতেই বিপর্যস্ত রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। তার ওপর চেপে বসেছে দেনার বোঝা।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) বিভিন্ন ফি ও পদ্মা অয়েলের কাছ থেকে জ্বালানি কেনা বাবদ প্রতিষ্ঠানটির বকেয়া ছাড়িয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা।
বেবিচক ও পদ্মা অয়েল বলছে, সম্প্রতি বিমান বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নিলেও তা নিতান্তই কম।
বেবিচকের চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এক হিসাবে দেখা যায়, দেশি এয়ারলাইনসগুলোর কাছে বিভিন্ন ফি বাবদ প্রতিষ্ঠানটির পাওনা ৫ হাজার ১৮৯ কোটি ৯৫ লাখ ৭৭ হাজার ৬৭৬ টাকা। এর মধ্যে বিমানের কাছেই প্রতিষ্ঠানটি পাবে ৪ হাজার ৩১৫ কোটি ১১ লাখ ৩১ হাজার ৭১৫ টাকা। অবশিষ্ট টাকা পাওনা আছে পাঁচ বেসরকারি এয়ারলাইনসের কাছে। এর মধ্যে তিনটির দীর্ঘদিন ধরে কোনো কার্যক্রম নেই।
চালু থাকা দুই বেসরকারি এয়ারলাইনস নভো এয়ার এবং ইউএস-বাংলার কাছে বেবিচকের পাওনা ২০ কোটি ১০ লাখ ৩৩ হাজার ২৪৭ টাকা। আর বন্ধ থাকা রিজেন্ট এয়ার, ইউনাইটেড এয়ার এবং জিএমজি এয়ারের কাছে বেবিচক পাবে ৮৫৪ কোটি ৭৪ লাখ তিন হাজার ৭১৪ টাকা।
সাধারণত দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দর ও আকাশে উড্ডয়নের সময় রাডার ও নেভিগেশন সেবা, বিমানবন্দর ব্যবহার, বিমানবন্দরে পার্কিং ও হ্যাঙ্গার, উড়োজাহাজের নিরাপত্তা বিধানসহ এয়ারলাইনসগুলোকে বিভিন্ন সেবা দিয়ে থাকে বেবিচক। এ ধরনের অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল সেবার জন্য নির্দিষ্ট হারে মাশুল দিয়ে থাকে এয়ারলাইনসগুলো।
নির্দিষ্ট সময়ে মাশুল দিতে ব্যর্থ হলে এয়ারলাইনসকে দিতে হয় ৭২ শতাংশ সারচার্জ। বেবিচকের টাকা দীর্ঘদিন পরিশোধ না করায় চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে বিমানের সারচার্জ।
মূল বকেয়া ৯২০ কোটি ১৬ লাখ ৮৮ হাজার ২৬৬ টাকা। চক্রবৃদ্ধি হারে এ টাকায় সারচার্জ এসেছে ৩ হাজার ১২৮ কোটি ২৪ লাখ ৭ হাজার ৫৮৪ টাকা।
বেবিচক চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান জানান, বিমান বকেয়া শোধের উদ্যোগ নিলেও সেটা নিতান্তই কম।
তিনি বলেন, ‘যে এয়ারলাইনসগুলো ফ্লাইটে আছে (যেমন: বিমান, তারপরে ইউএস-বাংলা এবং নভো এয়ার) অবশ্য টাকা দিয়ে যাচ্ছে ভালো। বিমানও দিচ্ছে। কিন্তু তাদের দেয়ার পরিমাণটা অনেক কম। আমরা তাদের কাছে যে পরিমাণ টাকা পাব, তার চেয়ে অনেক কম তারা দিচ্ছে।’
এদিকে এয়ারলাইনসের জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েলের কাছেও বিপুল পরিমাণে টাকা বাকি পড়েছে বিমানের।
পদ্মা অয়েল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিমানের কাছে এভিয়েশন ফুয়েল বা জেট ফুয়েলের দাম বাবদ প্রায় ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা পাবে তারা।
পদ্মা অয়েলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদুর রহমান জানান, সম্প্রতি কিস্তিতে পাওনা শোধ করা শুরু করেছে বিমান। তিনি বলেন, ‘বিমানের প্রায় ২ হাজার ১০০ কোটি টাকার মতো বাকি আছে। পাওনা দিতে তারাও চেষ্টা করছে। আপনারা তো জানেন তাদের অবস্থা। ফ্লাইট বন্ধ, আয় কমে গেছে।
‘তারপরেও তারা নতুনভাবে যেটা নিচ্ছে, সেগুলো তারা নিয়ম মেনেই পরিশোধ করছে। আর বকেয়া টাকা তারা কিস্তিতে শোধ করছে। তারা চেষ্টা করছে শোধ করার। তবে বিমান ছাড়া অন্য কোনো এয়ারলাইনসের কাছে কোনো বাকি নেই। অন্যরা সময়মতোই টাকা শোধ করেছে।’
করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর থেকেই একের পর এক সংকুচিত হয়ে এসেছে বিমানের আকাশ। এর ফলে বহরে থাকা উড়োজাহাজগুলোর সক্ষমতার দুই-তৃতীয়াংশই ব্যবহার করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।
তার ওপর প্রতিনিয়তই উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ ও লিজের টাকা শোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। ফ্লাইট না চালিয়েও গুনতে হচ্ছে এয়ারপোর্ট পার্কিং ফিসহ সরকারের অন্যান্য মাশুল।
বিমানের বহরে বর্তমানে রয়েছে ২১টি উড়োজাহাজ। এর মধ্যে নিজস্ব ১৫টি আর ভাড়ায় আনা হয়েছে ছয়টি।
নিজস্ব উড়োজাহাজের মধ্যে আছে ছয়টি বোয়িং সেভেন এইট সেভেন ড্রিমলাইনার, চারটি ট্রিপল সেভেন, দুটি সেভেন থ্রি সেভেন ও তিনটি ড্যাশ এইট মডেলের উড়োজাহাজ। ভাড়ায় আনা উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে চারটি সেভেন থ্রি সেভেন ও দুটি ড্যাশ এইট।
সংস্থার কর্তৃপক্ষ জানায়, করোনার আগে উড়োজাহাজের দৈনিক গড় ব্যবহার ছিল প্রায় ৯ ঘণ্টা। এখন তা দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৬৯ ঘণ্টায়। আন-অডিটেড হিসাবে গত বছরের এপ্রিল থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বিমানের লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৭৯ কোটি টাকা।
পাওনা পরিশোধের বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল বলেন, ‘পদ্মা অয়েলের কাছে যে বকেয়া আছে, সেটাকে আমরা আমাদের আয় থেকে প্রতি মাসে কিছু কিছু করে অ্যাডজাস্ট করে দিচ্ছি। এখন নতুন করে আমরা যে জ্বালানি তাদের কাছ থেকে নিচ্ছি, সেগুলো কিন্তু আমরা বাকি রাখছি না।’
তিনি বলেন, ‘বেবিচকের বিষয়টি হচ্ছে তাদের সাথে কিছু লিজ এগ্রিমেন্ট আছে; কিছু রেন্ট এগ্রিমেন্ট আছে। এগুলো অনেকদিন ধরেই আছে। এখন লিজ এবং রেন্টের বিষয়টি নিয়ে কখনো কখনো সমন্বয়ের সমস্যা দেখা দিয়েছে। লিজ হলে এক রকম আর রেন্ট হলে রেটটা আরেক রকমভাবে নির্ধারিত হয়।
‘সেটা আমরা এক রকম করতে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছি। সেটার জবাব আসলে তখন আমরা অ্যাডজাস্ট করব।’
মোস্তফা কামাল বলেন, ‘এককথায় বলতে গেলে সবগুলো এগ্রিমেন্টই লিজ। কিন্তু তারা কোথাও কোথাও রেট হিসেবে দেখিয়েছে। সে হিসেবে টাকা দবি করেছে। আমরা এটা একটা ইউনিক ফর্মে আনতে চাচ্ছি।
‘সেটা কয়েক জায়গায় অ্যাড্রেস করা হচ্ছে। এটা এক রকম হয়ে গেলে আমরা লিজ মানি হলে লিজ মানি দেব, রেন্ট হলে রেন্ট দেব। পুরো বিষয়টির একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’