স্বাধীনদেশ টেলিভিশন

সাপে কাঁটা রোগীর চিকিৎসায় নতুন আশার আলো

গত বছরের ৯ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদফতর আয়োজিত ‘ওরিয়েন্টেশন অন স্নেক বাইট ম্যানেজমেন্ট’ সম্মেলনে প্রকাশিত তথ্য মতে- বাংলাদেশে প্রতিবছর আনুমানিক ছয় লাখ মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন। আর মারা যান ছয় হাজার জন।

বাংলাদেশে সাধারণত পাঁচ ধরনের বিষাক্ত সাপের দেখা মেলে, এগুলো হলো— গোখরা, কেউটে, চন্দ্রবোড়া,  সবুজ সাপ ও সামুদ্রিক সাপ।

বর্ষাকালে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বাংলাদেশে সাপের কামড়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এই সময় সাপ বাইরে বেরিয়ে আসে বেশি। এছাড়া বন্যাকালে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে সাপ।

প্রতিবছর সারা বিশ্বে সর্পদংশনে প্রাণহানি ঘটে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষের এবং প্রায় ৪ লাখের’ও বেশি মানুষ প্রতিবছর বরণ করেন অন্ধত্ব ও বিকলঙ্গ হয়ে যাওয়াসহ বহু ধরনের শারীরিক বিপর্যয়।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (হু) মতে প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি। কারণ, হাসপাতালের বাইরে যারা মারা যান,  সরকারীভাবে তাদের হিসাব পাওয়া দুস্কর। ফলে এ ধরনের মৃত্যুর সঠিক হিসাব জানা এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না।

হু’র মতে, সাপের কামড়ে বেশির ভাগ লোক মারা যায় আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চল, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়৷ কারণ, সেখানে চিকিৎসা-সেবা অতটা উন্নত নয়৷  আর ৮০ শতাংশের মতো লোক নিজেরাই সাপের কামড় খেয়ে দ্বারস্থ হন স্থানীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার৷ অন্যদিকে দুর্গম ও দুরবর্তী এলাকার মানুষ খুব দ্রুত হাসপাতালে যেতে পারেন না, যা সাপের কামড়ের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন৷ একারণে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে৷

এই বৃহৎ সংখ্যার অন্যতম কারণ- প্রতিটি বিষের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন নির্দিষ্ট প্রতিষেধক। বিষাক্ত প্রাণী বেষ্টিত অঞ্চলে সবসময় হাতের নাগালে তাই বিষের প্রতিষেধক থাকা প্রয়োজন।

তবে প্রতিষেধক যদি হাতের নাগালে পাওয়াও যায়,  তবুও কোন নিশ্চয়তা নেই যে তা কাজে দেবে।

যে ব্যক্তি সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি বা তার আশেপাশের লোকজন যদি সাপটি কোন প্রজাতির তা খেয়াল না করেন বা শনাক্ত করতে ব্যর্থ হন- তবে প্রতিষেধক হাতের নাগালে থাকলেও বিশেষ কোনো লাভ হবে না।

সেক্ষেত্রে কামড়ানোর পর সাপটি ধরা পড়লে বা তার মৃতদেহ পাওয়া গেলে তবেই মাত্র চিকিৎসকরা নিশ্চিত হতে পারেন, যে তারা কোন ধরনের বিষের প্রতিষেধক ব্যবহার করবেন।

চিকিৎসা ও প্রতিষেধকের অভাবে সাপের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই বেশি। তবে আশার আলো দেখাচ্ছে নতুন এক গবেষণা থেকে পাওয়া প্রতিষেধক। ব্রিটেনের লিভারপুল স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন সম্প্রতি এমন একটি গবেষণার কথা প্রকাশ করেছে।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গত বিশ বছরে ১২ লাখ মানুষ সাপের কামড়ে মারা গেছে বলে নতুন এক গবেষণায় জানা গেছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে সর্পদংশনে বেশির ভাগ মানুষ মারা যায় কোবরা (ভারতীয় গোখরা) , রাসেলস ভাইপার এবং ক্রেইৎস (কালাচ) প্রজাতির সাপের কামড়ে। বাদবাকি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে অন্যান্য অন্তত ১২টি বিভিন্ন প্রজাতির সাপের কামড়ে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাপের কামড়ে মৃত্যু হয় যেসব এলাকায় দ্রুত চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায় না। ইলাইফের এই গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ২০০১ সালে থেকে ২০১৪ পর্যন্ত, সাপের কামড়ে মারা যাবার ৭০% ঘটনা ঘটেছে ভারতের আটটি রাজ্যে- বিহার, ঝাড়খণ্ড, মধ্য প্রদেশ, ওড়িশা, উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্র প্রদেশ, রাজস্থান এবং গুজরাটে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, “সাপের কামড় সস্পর্কে মানুষের মধ্যে অবৈজ্ঞানিক ভ্রান্ত ধারণা বিদ্যমান। এনিয়ে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার চর্চা এখনও ব্যাপকভাবে শুরু হয়নি”।

এঅবস্থায় পরিস্থিতি আরো বিগড়ে দিতে ভুল প্রতিষেধক প্রয়োগ কেবল অকেজই নয়, বরং আরো বিপজ্জনক হতে পারে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য। কারণ ভুল চিকিৎসা কখনও কখনও আরো ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

উপরন্তু, প্রতিষেধক ঘোড়ার মতো শক্তিশালী প্রাণীদের দেহে সাপের বিষ প্রয়োগ করে উৎপাদিত অ্যান্টিবডি সমন্বিত সিরাম সংগ্রহের মধ্য দিয়ে তৈরি করা হয় এবং তারপর সংরক্ষণ করা হয় ফ্রিজে।

দুর্ভাগ্যবশত, অনেক এলাকায় যেখানে বৈচিত্র্যময় এবং বিষাক্ত সাপ প্রচুর, সেখানেও লাগাতার রেফ্রিজারেশনের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা যায় না। অনেকক্ষেত্রে, দেখা যায় পান করে প্রয়োগ করা যায় এমন কোনো প্রতিষেধক নেই। সেক্ষেত্রে যিনি আক্রান্তের দেহে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রতিষেধক প্রয়োগ করবেন তারও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, অন্যথায় বিঘ্ন বাড়তে পারে আরো।

ব্রিটেনের লিভারপুল স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের  ড. কেসওয়েল মনে করেন, তিনি একটি প্রতিষেধক খুঁজে পেয়েছেন যা সত্যিই স্থিতিশীল এবং পান করার মাধ্যমেও প্রয়োগ করা যায়। যদিও এটা সার্বজনীন নয়, কিন্তু বিষধর সাপের যেকোনো প্রজাতির বিরুদ্ধে এটি কাজ করে। বিশেষ কোঁড়ে, সারাবিশ্বে সাপের কামড়ে অর্ধেকের’ও বেশি মৃত্যুর জন্য দায়ী অথবা ভাইপার ও ভাইপেরাইড সাপের বিরুদ্ধে রয়েছে এর কার্যকারিতা।

যদিও ভাইপারের বিষের সাথে অন্যান্য প্রজাতির সাপের বিষে পার্থক্য রয়েছে, তবে সবগুলো বিষেরই রয়েছে একটি নির্দিষ্ট রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য। তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের টক্সিন এনজাইমের দুটি গ্রুপের একটি- Zn2+ ধাতুপ্রোটিনাস আর ফসফোলিপাসে a2s একটি। বিশেষ করে, এই এনজাইমগুলো টিস্যুর ব্যাপক ক্ষতি করে এবং রক্তক্ষরণের জন্য দায়ী যা ভাইপারের কামড়কে এত মারাত্মক করে তোলে।

যেসব ওষুধ Zn2+ মেটাললোপ্রোটিনাস এবং ফসফোলিপাসে এ২এস কে নিষ্ক্রিয় করে দেয়, তারা ভাইপার কামড়ের জন্য কার্যকর প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করতে পারে। তাই ড. কেসওয়েল এবং তার সহকর্মীরা এই বিষয় মাথায় রেখে প্রতিষেধক খোঁজার সিদ্ধান্ত নেন।

অনুসন্ধানে জন্য তিনটি সম্ভাবনাময় উৎস পেয়ে যান তারা। এক, ভারেসপ্লাদিব, ফসফোলিপাসে এ২এস এর একটি প্রতিরোধক যা বিভিন্ন ধরনের প্রদাহজনিত রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয়, মারিমাস্তাট, যা একবার ক্যানসারের প্রতিষেধক হিসেবে পরীক্ষা করা হয়েছিল। যদিও সেক্ষেত্রে তা অকার্যকর হয়েছিল, কিন্তু Zn2+ ধাতুপ্রোটিন সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত করে। তৃতীয়, 2,3-ডিমারক্যাপটো-1-প্রোপেনেসালফোনিক এসিড (ডিএমপি), ভারী ধাতু বিষক্রিয়া চিকিতৎসার জন্য যা ব্যবহার হয়ে থাকে এবং যা Zn2+ ধাতুর প্রোটিন নির্মূল করতে কাজে দেয়।

তাদের আবিষ্কার পরীক্ষা করার জন্য ড. কেসওয়েল এবং তার দল ভিপেরিডাই এর বিভিন্ন মাত্রার বিষ যা প্রায়ই মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী তা একদল ইঁদুরের দেহে প্রয়োগ করে ভাগ্যের উপর ইঁদুরদের ছেড়ে দেয় তারা।

বিষগুলোর মাঝে আরো ছিল পশ্চিম আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার ভাইপার; রাসেল ভাইপার, আফ্রিকান পাফ অ্যাডার এবং মধ্য আমেরিকা থেকে ফার-ডি-ল্যান্স।

গবেষণার ইঁদুরগুলো এক ঘন্টার মধ্যে মারা যায়। মানে তাদের ওষুধ খুব একটা কাজে দেয়নি। ডিএমপিএস এর সমন্বয় কিছু বিষের ক্ষেত্রে কার্যকর ছিল, কিন্তু অন্য বিষের ক্ষেত্রে নয়। যদিও, ভারেসপ্লাডিব এর সমন্বয়ে প্রয়োগ করা বিষযুক্ত ইঁদুরগুলো বেঁচে ছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য।

আর এটাই ছিল গবেষণার জন্য উৎসাহব্যঞ্জক। ভারেসপ্লাডিব এবং মারিমাস্তাট উভয়ই তাপমাত্রার দিক থেকে স্থিতিশীল এবং একমাত্র নিরাময়ক হিসেবে মানুষের নিরাপত্তার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, তাই মানুষের উপর এটি পরীক্ষা করা সহজ হবে যদি মানুষ আগ্রহী হয় গবেষণার প্রয়োজনে এগিয়ে আসতে।

এরপরেও এখনো অনেক গবেষণা বাকি এই ধরনের সিদ্ধান্তে আসার জন্য। বিশেষ করে, এখন পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় পান করার বদলে প্রত্যেকটি ইঁদুরের উপরে প্রতিষেধক প্রয়োগ করা হয়েছে ইনজেকশন এর মাধ্যমেই।

তবে ড. কেসওয়েল এবং তার সহকর্মীরা আশা করেন যে তারা যা আবিষ্কার করেছেন তা মানুষের মধ্যে কার্যকর হবে,  এবং এটি সাপের কামড়ের চিকিৎসাকে অনেক সহজ করে দেবে।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

আরো সংবাদ